বিশেষ প্রতিনিধি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ‘মূলত হত্যার জন্যই মধ্যযুগীয় কায়দায় আমাকে নির্যাতন করা হয়েছে। হামলাকারীরা আমার দুই পায়ের রগ কেটে দিয়েছে, হাত কেটে দিয়েছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে সারা শরীরে আঘাত করেছে। এমনকি আমার যৌনাঙ্গ, স্তন ক্ষত বিক্ষত করেছে। হামলার পর গত আটদিন ধরে হাসপাতালে আমি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছি। অথচ থানায় মামলা করার পরও, আসামীরা গ্রামে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে আমার গোটা পরিবার এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় রাত কাটাচ্ছে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত ভর্তিকৃত, বর্বোরচিত হামলা শিকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের নাছিমা আক্তার (৩২) এই প্রতিনিধির কাছে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই তার কথাগুলো বলছিলেন।

জানা যায়, গত ৩১ আগস্ট রাতে জায়গা সম্পত্তির বিরোধ নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষের লোকজন নাছিমার উপর ওই ন্যাক্কারজনক হামলা করে। এ ঘটনার পর নাছিমা গ্রামের ধণাঢ্য ব্যক্তি মোছা মিয়াকে প্রধান আসামি করে ১৬ জনের নাম উল্লেখসহ মামলা করেছেন। তবে এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

নবীনগর থানার ওসি মাহাবুব আলম আজ সকালে মামলার সত্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় নাছিমা আক্তার আজ সকালে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, জায়গা সম্পত্তির বিরোধ নিয়ে গ্রামের কিছু লোকজনের সাথে তার পরিবারের বিরোধ রয়েছে। গ্রামে নাছিমাদের একটি বাগানবাড়ি নিয়েই মূলত ওই বিরোধের সৃষ্টি।

এলাকার লোকজন জানান, ঘটনার দিন গত ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহর থেকে নি:সন্তান নাছিমা আক্তার শিবপুরে তার নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন। পথিমথ্যে রাত আনুমানিক সাড়ে সাতটার দিকে শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে উত্তর পূর্ব কোণের অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি খালি জায়গায় পূর্ব থেকে ওৎ পেতে থাকা সশস্ত্র ২০/২৫ জন লোক নাছিমার ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়।

হামলাকারীরা এক পর্যায়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নাছিমার দুই পা ও হাতের রগ কেটে দেয়। এরপর নাছিমাকে বিবস্ত্র করে তার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে। হামলাকারীরা এক পর্যায়ে তাঁকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। পরে তাকে মুমুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে, তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো হয়।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে নাছিমা আক্তা রর আজ সকালে অভিযোগ করে বলেন, 'গত ইউপি নির্বাচনে (২০২২) পরাজিত প্রার্থী (আওয়ামীলীগ সমর্থক) মোছা মিয়ার নেতৃত্বে আমার ওপর এই সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। আমি হামলাকারীদের বেশীরভাগকে চিনেছি। মামলায় তাদের নামও দিয়েছি। মূলত আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এই হামলা হয়। মামলার এক নম্বর আসামি পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মোছা মিয়া হামলার সময় নিজের হাতে আমাকে জঘণ্যভাবে যৌন নির্যাতন করে আমার যৌনাঙ্গ ও স্তন ক্ষত বিক্ষত করে। আমি তাই মোছাসহ সকল হামলাকারীদের কঠোর বিচার দেখে যেতে চাই।'

এদিকে ঘটনার পর হামলাকারীরা আবারও হামলার হুমকি দিচ্ছেন বলে নাছিমা অভিযোগ করেন। ঘটনার পর বিগত আটদিনেও কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায়, নাছিমার গোটা পরিবার আবারও হামলার ভয়ে চরম আতংকে রয়েছেন বলেও আশংকা প্রকাশ করেন নাছিমা।

তবে এ ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় রয়েছে নানা মিশ্র আলোচনা। গতকাল বুধবার সরজমিনে শিবপুরে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে, এ বিষয়ে গ্রামের কেউই প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজী হননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গ্রামবাসি জানান, 'নাছিমা নিজেও একজন ভয়ংকর দু:সাহসিক নারী। মামলাবাজ ও মতলববাজ হিসেবে পরিচিত এই নি:সন্তান নাছিমাকে নিয়েও গ্রামবাসির মনে রয়েছে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক! নাছিমার সঙ্গে রয়েছে রাঘব বোয়ালদের সুসম্পর্ক। তাই নাছিমাকে গ্রামের অনেকেই এড়িয়ে চলেন।'

এ বিষয়ে মামলার ১ নম্বর আসামি মো মোছা মিয়া বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অসত্য। আমি ৪০ বছর বিদেশে থেকে গ্রামে এসে এখন বেশ ভালো অবস্থায় আছি বলে, আমাকে নানাভাবে হয়রাণী করতেই আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যে মামলা দেয়া হচ্ছে। সুষ্ঠু তদন্ত হলেই আমার বিরুদ্ধে আনা এসব মিথ্যে অভিযোগ খারিজ হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। তাই আমি মামলাটির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চাই।'

এলাকার ধণাঢ্য ব্যক্তি মোছা মিয়াকে মামলার এক নম্বর আসামি করার পেছনে শিবপুরের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা এমআর মুজিবের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করেন মোছা মিয়া।
তবে চেয়ারম্যান মুজিব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মোছা এর আগেও গ্রামের তফাজ্জল হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি। মোছার কাড়ি কাড়ি টাকা থাকায় একজন বিতর্কিত 'জনপ্রতিনিধি' তাকে বারবার রক্ষা করছেন।

নবীনগর থানার ওসি মাহাবুব আলম বলেন, 'ঘটনাটি আটদিন আগে হলেও, নাছিমা হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তিনি মামলা দিয়েছেন গতকাল বুধবার। আমরা রাতেই (বুধবার) মামলাটি নথিভূক্ত করে একজন চৌকস এস আইকে মামলাটি তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছি।'

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার সাখাওয়াত হোসেন আজ দুপুরে বলেন, 'তদন্তে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত যাকেই পাওয়া যাবে, তিনি যত প্রভাবশালীর ছত্রচ্ছায়াই থাকুক, কেউ এ থেকে রেহাই পাবে না। আবার তদন্তে নিরাপরাধ কারও নাম আসামির তালিকায় পাওয়া গেলেও, তাকে ন্যুন্যতম হয়রাণী করা হবে না।'

পুলিশ সুপার ঘটনাটির প্রকৃত রহস্য বের করতে গণমাধ্যম কর্মীদেরও সহযোগিতা চান।

(জিডি/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২৩)