চৌধুরী আবদুল হান্নান


সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন নামে স্বল্প পরিচিত  ‘অধিকার’ এর সম্পাদক আইনজীবী আদিলুররহমান খান ও পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিনকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সৃষ্ট তাণ্ডব ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের বিষয়ে অসত্য ও বিকৃত তথ্য প্রচারের অভিযোগে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক গত ১৪ সেপ্টেম্বর এ রায় ঘোষণা করেন। আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ।

বিশ্বের ৭২টি মানবাধিকার সংস্থা আদালতের সাজাপ্রাপ্ত আসামির নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার জন্য আহবান জানিয়েছে। এমন আহবান একটি দেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ। নিজ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, সে বিষয়ে কোনো কথা নেই কিন্ত অন্য দেশের ব্যাপারে অতি উৎসাহ দেখা যায়।

সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মুক্তিদানের আহবান না জানিয়ে এ বিষয়ে অধিকতর তদন্তের কথা বললে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর গ্রহণ যোগ্যতা অনেক বৃদ্ধি পেত। আর তাছাড়া, সরকার তো সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তি দিতে পারে না, বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। আদালতের রায়ে কেউ ক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ রয়েছে।

তারা সাহসিকতার সাথে আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আলাদাভাবে নিরপেক্ষ সোর্সের মাধ্যমে একটি গোপন তদন্ত পরিচালনা করতে পারতেন।সত্য উদঘাটনের জন্য এমন গোপন তদন্ত করাই যায়। তাতে জনমনে একটি বার্তা পৌছাতো যে, সংগঠনগুলো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সত্য উদঘাটনে প্রকৃতই আন্তরিক। তাছাড়া, আদালতের প্রতিটি রায় শতভাগ ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে না; তা না হলে নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে কখনও পরিবর্তন হতো না।

এখানে গত ১৯ জানুয়ারী যুক্তরাজ্য থেকে সম্প্রচারিত বিবিসি’র “ইন্ডিয়া : দ্য মোদী কোয়েশ্চন” তথ্যচিত্রের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। তথ্যচিত্রে নতুন যে তথ্যটি এসেছ , তা হলো যুক্তরাজ্য ২০০২ সালের ভারতের গুজরাট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার (মৃত্যু : ১০৪৪ জন, মুসলমান- ৭৯০ জন) গোপন তদন্ত করেছিল এবং তদন্ত প্রতিবেদনে মুখ্যমন্ত্রী (তৎকালীন) নরেন্দ্র মোদীকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। তিনি দাঙ্গা থামননি, বরং দাঙ্গা রোখার চেষ্টা কারীদের শায়েস্তা করেন (সমকাল ২১ জানুয়ারী, ২৩)।

কিন্ত ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ওই সময়ে গুজরাট রাজ্যে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য নরেন্দ্র মোদীকে নির্দোষ ঘোষণা করেছেন এবং সে কারণেই বিবিসি’র এ গোপন তদন্ত; তাতে ক্ষুব্ধ ভারত।

আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো ঘটনার গভীরে না গিয়ে সাজাপ্রাপ্তদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার আহবান, আর যাই হোক, মানবাধিকারের জয়গান মনে করা যায় না। এতে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও বৈধতা নিয়ে মানুষের আস্থা কমে যাবে, সন্দেহ নেই।

অন্যদিকে সাইবার ট্রাইব্যুনালের এ রায়কে ফরমায়েশি বলার সুযোগ নেই, কারণ ৯ বছর যাবৎ চলমান মামলায় শুনানিকালে ৩২ জন সাক্ষীকে জেরা করা হয় এবং বাদী-বিবাদীকে সমান সুযোগ দিয়ে মামলার সমাপ্তি টানা হয়।

ওই সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের দাবি ছিল — আমাদের মহানবী (সঃ) সম্পর্কে অপ্রীতিকর মন্তব্যকারী “নাস্তিক ব্লগারদের” ফাঁসি কার্যকর করার জন্য একটি ব্লাসফেমি আইন প্রনয়ন এবং জন সম্মুখে নারী পুরুষের মেলামেশা নিষিদ্ধকরণ।

দলের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফি ও জুনায়েদ বাবু নাগরির নেতৃত্বে মূলত চিটাগং অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মাদ্রাসা ছাত্র ট্রেনে চেপে, রিজার্ভ করা বাসে এসে শাপলা চত্বরে একত্রিত হয়েছিল।

তাদের অধিকাংশই ছিল কিশোর-তরুণ এবং অনেকেই জানে না তারা কেন এখানে এসেছে। এক পর্যায়ে তারা শাপলা চত্বরে অবস্থান করার কর্মসূচী ঘোষণা করে, সুযোগ সন্ধানী কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এ কর্সূচীতে অংশ নেওয়ার খবর প্রচারিত হয়।উদ্দেশ্য সমাবেশকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দেওয়া। অবস্থানরত জনতার শক্তি বৃদ্ধি পায়, আসন্ন ঘূর্ণিঝড় যেন টর্ণেডোতে পরিণত হবে। উম্মত্ত জনতা বায়তুল মোকাররম মসজিদের আশপাশে বইয়ের দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীরা এখন বিস্ফোরোন্মুখ, অ্যাংরি মব!

অন্যদিকে মতিঝিলে সরকারের নগদ অর্থ ভান্ডার বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। এ অবস্থায় যৌথ বাহিনী ঝটিকা অভিযান চালিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাতের মধ্যে অবস্থানকারীদের শাপলা চত্বর থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। গুজব রটে, গুজবের ডালপালা বিস্তার করে প্রচার হয় শত শত কর্মী নিহত হয়েছে, ট্রাক ভর্তি করে সরিয়ে নিয়ে লাশ গুম করা হয়েছে।

এমনই এক অরাজক পরিস্থিতিতে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ একটি কট্টর মৌলবাদী গোষ্ঠীকে মিথ্যা, বিকৃত তথ্য প্রচারের মাধ্যমে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে যে সাজা হয়েছে, তা লঘু দণ্ডই বলা যায়।

আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী সোচ্চার হওয়ায় মর্মাহত হয়েছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা।

মৌলবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে মৌলবাদকে উসকে দেওয়া, উৎসাহিত করা এবং সংখ্যালঘুদের ঝুঁকিতে ফেলা থেকে বিরত থাকতে বিদেশিদের আহবান জানিয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, অধ্যাপক জাফর ইকবাল, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ স্বনামধণ্য ব্যক্তিবর্গ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।