ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আজ শুক্রবার আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস ২০২৩। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘অসমতার বিরুদ্ধে লড়াই করি, দূর্যোগ সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ি' দিবসটি পালন উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। দুর্যোগের ঝুঁকিহ্রাসে জনগণ ও সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা বাড়াতেই এই উদ্যোগ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এদেশে প্রতিবছর কোনো না কোনো দুর্যোগে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ব্যাপকতা প্রমাণ করে দুর্যোগের পূর্ব সতর্কীকরণ ও ঝুঁকি কমানোই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল হওয়া উচিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় জনগণের জন্য দুর্যোগ পূর্ব পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বর্তমান সরকারের অনেক অবদান আছে তাঁর মধ্যেই দুর্যোগঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় এ পর্যন্ত ৯৪ হাজার ৩৩৮টি বাসগৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও ৪৪ হাজার ৯০৯টি দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।

উপকূলীয় অঞ্চলে ৩২৭টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় ২৩০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও ৪২৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে আরও এক হাজারটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংগ্রহের জন্য প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পাশাপাশি ভূমিকম্পসহ বড় ধরনের দুর্যোগ পরবর্তী অনুসন্ধান, উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সমন্বিতভাবে মোকাবিলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ওয়ান স্টপ সেন্টার হিসেবে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনইওসি) প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে ও পূর্বাভাস দিতে ‘হাওর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প‘ এবং ‘বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দেশব্যাপী বজ্রনিরোধক কাঠামো স্থাপন প্রকল্প' গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগ কবলিত মানুষকে উদ্ধার করার জন্য ৬০টি বিশেষ মাল্টিপারপাস রেসকিউ বোট তৈরি ও হস্তান্তর কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও জনান প্রতিমন্ত্রী।প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রোধ করার উপায় নেই, কিন্তু এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যথাযথ প্রস্তুতি ও উদ্যোগ গ্রহণের মধ্যদিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। আমলে নেয়া জরুরি, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। অন্যদিকে বলাই বাহুল্য, প্রায় প্রতি বছরই দেখা যায়, বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয় কালবৈশাখী তা-ব। আর এতে মানুষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। দিশাহারা পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়। জীবন বিপর্যস্ত হয়। সঙ্গত কারণেই সামগ্রিক পরিস্থিতি আমলে নেয়া এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকর উদ্যোগ অব্যাহত রাখা অপরিহার্য বলেই প্রতীয়মান হয়।

দুর্যোগের প্রকারভেদ :প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভিন্ন রকম– ভূমিকম্প, বন্যা, ঝড়, দাবানল ইত্যাদি। এসব এতই আকস্মিক ও অনিবার্য যে এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। তবে তাৎক্ষণিক উদ্ধারকার্য ও স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলি সদর্থক ভূমিকা নিতে পারে।

> ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।

যেভাবে ঝড়ের তা-বে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সামনে আসছে তা আমলে নিতে হবে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। একইসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, ঝড়ের আশঙ্কাকে সামনে রেখে যথাযথ প্রস্তুতিও নিতে হবে। কেননা সঠিক প্রস্তুতি নিশ্চিত হলে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করতে হবে। এটাও মনে রাখা সমীচীন, যেহেতু বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে দুর্যোগপ্রবণ দেশ, সঙ্গত কারণেই দুর্যোগ মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ ও যথাযথ প্রস্তুতির বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে আমরা বলতে চাই, ঝড়-বৃষ্টি বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ। এছাড়া দুর্যোগের কবলে বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। বন্যা জলোচ্ছ্বাসসহ নানা কারণে বাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের বিষয়ও আলোচনায় আসে। ফলে এগুলোও আমলে নিতে হবে। নিম্নমানের নির্মাণ বা যে কোনো ধরনের অবেহলার কারণে দুর্ভোগ বাড়লে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ফলে এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

বলা দরকার, এবার ঝড়ের তা-বকে কেন্দ্র করে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা আমলে নেয়ার পাশাপাশি করণীয় নির্ধারণ সাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। এছাড়া ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে এটাও এড়ানো যাবে না। এক্ষেত্রে বলা দরকার, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাত বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। একই সঙ্গে বজ্রপাতে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই অস্বাভাবিক বজ্রপাত হচ্ছে মর্মে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। যা স্বাভাবিকভাবেই উৎকণ্ঠার। প্রসঙ্গত, আমরা এটাও বলতে চাই, আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা। মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে কৃষকের প্রাণহানিই ঘটে সবচেয়ে বেশি।আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও সঠিক বাস্তবায়ন দরকার। উদাহারনসরূপ বলা যায়, নদীর নাব্যতা বাড়ানো। নদীর গতিপথ পরিষ্কারের জন্য উন্নত প্রযুক্তিতে ড্রেজিং করে নদীর গতিপথে জমে থাকা পলি অপসারণ করে নদীর নাব্যতা ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে দরকার। নদীর নাব্যতা বাড়ানো কোথায় হবে ও কিভাবে হবে তা সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে করতে হবে। এক্ষেত্রে, বিষয়ভিত্তিক গবেষণা ও প্রযুক্তির মধ্যে সমন্বয় অত্যাবশ্যক। এক্সপার্টরা বলেছেন, গভীরতা বাড়ানোর জন্য নদীর "প্রাকৃতিক শক্তিকে" ব্যবহার করতে হবে।

বন্যা ও জলাবদ্ধতার যে কারণগুলো মানুষের সৃষ্টি, তার সমাধানে সরকারের ধারাবাহিক পদক্ষেপ দরকার। বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদী, খাল, বিল, হাওড়, ও অন্যান্য জলাভূমি দখলমুক্ত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শহরের আশেপাশে জলাভূমি ভরাট করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ রোধ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীসহ অনেক জেলা শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে অসম্ভব। শহরে জলাবদ্ধতা কমাতে হলে এলাকাভিত্তিক সমাধান না খুঁজে পুরো নগরী এবং আশপাশের এলাকার জন্য পরিকল্পনা, সঠিক নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা দরকার। মোদ্দা কথা, হল বন্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, সমাধান খুঁজতে হবে ব্যবস্থাপনায়।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫০টির ওপরে অভিন্ন নদী আছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণে তিস্তা-গঙ্গাসহ যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক। ফারাক্কা বাঁধের কারণেই বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে খরা এবং বর্ষাকালে বন্যার কবলে পতিত হয়। ভারত সীমান্তে শুধু ফারাক্কা বাঁধই নয়, তিস্তাসহ প্রায় সবকটি নদীর অবকাঠামোগত উন্নয়ন মনিটরিং করা দরকার।এক্ষেত্রে ওয়াটার ডিপ্লোম্যাসি আরও জোরদার করা বাঞ্ছনীয়।

বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পলিসি-প্রাকটিস গ্যাপটা কমানো জরুরি। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালার প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করা দরকার। যেমন, জাতীয় পানি নীতি, ১৯৯৯ তে বর্ণিত অংশীদার ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনাসহ বেশিভাগ সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ফ্লাড একশন প্লান বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ের উপর কম গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। প্রথাগত ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে, এদেশে বন্যা ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির সঙ্গে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানেরও প্রয়োগ দরকার।

বন্যা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা "ডেলটা প্লান ২১০০" প্রস্তুত করার প্রায় দুই বছর হচ্ছে, এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। এই প্লান বাস্তবায়নে, সরকার ওয়ার্ল্ড ব্যাংক হতে ২ বিলিয়ন ইউএস ডলার পাওয়ার জোড় তৎপরতা চালাচ্ছে এবং গ্রিন সিগন্যালও পেয়েছে। এই অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রকৃতি-ভিত্তিক সল্যুশনের উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অন্যান্য স্ট্রাটেজি ও পলিসির মত, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে জাতীয় পর্যায়ের অভীষ্ট লক্ষ্য, যেমন ২০৩০ সালের মধ্যে (ক) চরম দারিদ্র দূরীকরণ, (খ) উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন, এবং (গ) একটি সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন সম্ভব হবে না।

সারকথা হল, টেকসই দুর্যোগ মোকাবেলা অনেকটাই নির্ভর করছে আমরা কতটা জোর দিচ্ছি প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের উপর। আইপিসিসি'র পঞ্চম আসেসমেন্টের প্রতিবেদন অনুসারে জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সফল না হলে নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাত-সহিষ্ণু সমৃদ্ধ বদ্বীপ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বে করণীয়

১. দুর্যোগের সময় কোন এলাকার লোক কোন আশ্রয়ে যাবে, গরু মহিষাদি কোথায় থাকবে তা আগে ঠিক করে রাখুন এবং জায়গা চিনিয়ে রাখুন।

২. বাড়িতে, গ্রামে, রাস্তায় ও বাঁধের উপর গাছ লাগান।

৩. যথাসম্ভব উঁচু স্থানে শক্ত করে ঘর তৈরি করুন। পাকা ভিত্তির উপর লোহার বা কাঠের পিলার এবং ফ্রেম দিয়ে তার উপর ছাউনি দিন। ছাউনিতে টিন ব্যবহার না করা ভাল। কারণ ঝড়ের সময় টিন উড়ে মানুষ ও গবাদি পশুকে আহত করতে পারে। তবে ০.৫ মি. মি. পুরুত্ব বিশিষ্ট টিন ও জেহুক ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. উঁচু জায়গায় টিউবওয়েল স্থাপন করুন, যাতে জলোচ্ছ্বাসের লোনা ও ময়লা পানি টিউবওয়েলে ঢুকতে না পারে।

৫. জেলে নৌকা,লঞ্চ ও ট্রলারে রেডিও রাখুন। সকাল, দুপুর ও বিকালে আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার অভ্যাস করুণ।

৬. সম্ভব হলে বাড়িতে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম (ব্যান্ডেজ, ডেটল প্রভৃতি) রাখুন।

৭. জলোচ্ছ্বাসের পানির প্রকোপ থেকে রক্ষায় নানারকম শস্যের বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিন।

৮. বাড়িতে এবং রাস্তায় নারিকেল, কলাগাছ, বাঁশ, তাল, কড়ই ও অন্যান্য শক্ত গাছপালা লাগান। এসব গাছ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বেগ কমিয়ে দেয়। এর ফলে মানুষ দুর্যোগের কবল থেকে বাঁচতে পারে।

৯. নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকেরই সাঁতার শেখা উচিত।

১০. ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে বা অন্য আশ্রয়ে যাবার সময় কি কি জরুরি জিনিস সঙ্গে নেয়া যাবে এবং কি কি জিনিস মাটিতে পুঁতে রাখা হবে তা ঠিক করে সে অনুসারে প্রস্তুতি নেয়া উচিত।

১১. আর্থিক সামর্থ থাকলে ঘরের মধ্যে একটি পাকা গর্ত করুন। জলোচ্ছ্বাসের পূর্বে এই পাকা গর্তের মধ্যে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখতে পারবেন।

১২. ডায়ারিয়া মহামারীর প্রতি সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। শিশুদের ডায়ারিয়া হলে কিভাবে খাবার স্যালাইন তৈরি করতে হবে সে বিষয়ে পরিবারের সকলকে প্রশিক্ষণ দিন।

১৩. ঘূর্ণিঝড়ের মাসগুলোতে বাড়িতে মুড়ি, চিড়া, বিস্কুট জাতীয় শুকনো খাবার রাখা ভাল।

১৪. নোংরা পানি কিভাবে ফিটকারি বা ফিল্টার দ্বারা খাবার ও ব্যবহারের উপযোগী করা যায় সে বিষয়ে মহিলাদের এবং আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিন।

১৫. ঘূর্ণিঝড়ের পরে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করুন। বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ। মাটির বড় হাঁড়িতে বা ড্রামে পানি রেখে তার মুখ ভালভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে যাতে পোকা-মাকড়, ময়লা-আবর্জনা ঢুকতে না পারে।

পূর্বাভাস পাবার পর দুর্যোগকালে করণীয়

১. আপনার ঘরগুলোর অবস্থা পরীক্ষা করুন, আরও মজবুত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যেমন মাটিতে খুঁটি পুঁতে দড়ি দিয়ে ঘরের বিভিন্ন অংশ বাঁধা।

২. সিপিপি এর স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিন।

৩. বিপদ সংকেত পাওয়া মাত্র বাড়ির মেয়ে, শিশু ও বৃদ্ধাদের আগে নিকটবর্তী নিরাপদ স্থানে বা আশ্রয়কেন্দ্রে পোঁছে দিতে প্রস্তুত হোন এবং অপসারণ নির্দেশের পরে সময় নষ্ট না করে দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে যান।

৪. বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় আগুন নিভিয়ে যাবেন।

৫. আপনার অতি প্রয়োজনীয় কিছু দ্রব্যসামগ্রী যেমন- ডাল, চাল, দিয়াশলাই, শুষ্ক কাঠ, পানি ফিটকিরি, চিনি, নিয়মিত ব্যবহৃত ঔষধ, বইপত্র, ব্যান্ডেজ, তুলা, ওরস্যালাইন ইত্যাদি পানি নিরোধন পলিথিন ব্যাগে ভরে গর্তে রেখে ঢাকনা দিয়ে পুঁতে রাখুন।

৬. আপনার গরু-ছাগল নিকটস্থ উঁচু বাঁধে অথবা কিল্লা বা উঁচুস্থানে রাখুন। কোন অবস্থায়ই গোয়াল ঘরে বেঁধে রাখবেন না। কোন উঁচু জায়গা না থাকলে ছেড়ে দিন, বাঁচার চেষ্টা করতে দিন।

৭. শক্ত গাছের সাথে কয়েক গোছা লম্বা মোটা শক্ত রশি বেঁধে রাখুন। রশি ধরে অথবা রশির সাথে নিজেকে বেঁধে রাখুন যাতে প্রবল ঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিতে না পারে।

০৮. আশ্রয় নেয়ার জন্য নির্ধারিত বাড়ির আশেপাশে গাছের ডালপালা আসন্ন ঝড়ের পূর্বেই কেটে রাখুন,যাতে ঝড়ে গাছগুলো ভেঙে বা উপড়িয়ে না যায়।

০৯. রেডিওতে প্রতি ১৫ মিনিট পর পর ঘূর্ণিঝড়ের খবর শুনতে থাকুন।

১০. দলিলপত্র ও টাকা-পয়সা পলিথিনে মুড়ে নিজের শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখুন অথবা সুনির্দিষ্ট স্থানে পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখুন।

১১. টিউবওয়েলের মাথা খুলে পৃথকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে এবং টিউবওয়েলের খোলা মুখ পলিথিন দিয়ে ভালভাবে আটকে রাখতে হবে যাতে ময়লা বা লবনাক্ত পানি টিউবওয়েলের মধ্যে প্রবেশ না করতে পারে।

দুর্যোগ পরবর্তী করণীয়

১. রাস্তা-ঘাটের উপর উপড়ে পড়া গাছপালা সরিয়ে ফেলুন যাতে সহজে সাহায্যকারী দল আসতে পারে এবং দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব হয়।

২. আশ্রয়কেন্দ্র হতে মানুষকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করুন এবং নিজের ভিটায় বা গ্রামে অন্যদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিন।

৩. অতি দ্রুত উদ্ধার দল নিয়ে খাল, নদী, পুকুর ও সমুদ্রে ভাসা বা বনাঞ্চলে বা কাদার মধ্যে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করুন।

৪. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ যাতে শুধু এনজিও বা সরকারি সাহায্যের অপেক্ষায় বসে না থেকে নিজে যেন অন্যকে সাহায্য করে সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।

৫. রিলিফের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সচেষ্ট হোন। রিলিফের পরিবর্তে কাজ করুন। কাজের সুযোগ সৃষ্টি করুন। রিলিফ যেন মানুষকে কর্মবিমুখ না করে কাজে উৎসাহি করে সেভাবে রিলিফ বিতরণ করতে হবে।

৬. দ্বীপের বা চরের নিকটবর্তী কাদার মধ্যে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারের জন্য দলবদ্ধ হয়ে দড়ি ও নৌকার সাহায্যে লোক উদ্ধার কর্মআরম্ভ করুন। কাদায় আটকে পড়া লোকের কাছে দড়ি বা বাঁশ পৌঁছে দিয়ে তাকে উদ্ধার কাজে সাহায্য করা যায়।

৭. ঝড় একটু কমলেই ঘর থেকে বের হবেন না। পরে আরও প্রবল বেগে অন্যদিক থেকে ঝড় আসার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

৮. পুকুরের বা নদীর পানি ফুটিয়ে পান করুন। বৃষ্টির পানি ধরে রাখুন।

৯. নারী, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ লোকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ত্রাণ বন্টন (আলাদা লাইনে) করুন।

১০. দ্রুত উৎপাদনশীল ধান ও শাক-সব্জির জন্য জমি প্রস্তুত করুন,বীজ সংগ্রহ করুন এবং কৃষি কাজ শুরু করুন যাতে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফসল ঘরে আসে।

পরিশেষে বলতে চাই, ঝড়ের তা-বসহ যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি জারি রাখতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করে পুনর্বাসনেও উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছরই ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রোধ করার কোনো উপায় নেই এটা যেমন ঠিক, তেমনি প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব- যা আমলে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে। এবারে ঝড়ের তা-বের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আমলে নেয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। একইসঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে যে কোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে সামগ্রিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।