গোপাল নাথ বাবুল


ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর। কলঙ্কিত এবং রক্তপাতের ইতিহাস। দুই কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধার মহাভুলের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে রঞ্জিত একটি কলঙ্কিত দিন। বরাবরের মতো এ দিনটির আলোচনায় ওঠে আসে বীর উত্তম ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফ এবং বীর উত্তম কর্নেল আবু তাহেরের নাম। ৭ নভেম্বর ক্ষমতার লড়াইকে ঘিরেই মুক্তিযুদ্ধের দুই চৌকষ এবং অদম্য সাহসী সেক্টর কমান্ডার নিহত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে এদিনটির প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এরপর ৩ নভেম্বর জেলে আওয়ামীলীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বরের সৃষ্টি। 

৭৫ এর ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। দেশ হয়ে যায় তখন দিশাহীন, বিশৃঙ্খল, বিভক্ত। জুনিয়র খুনী অফিসার পাকিস্তান ফেরত ফারুক ও রশীদের বেপরোয়া আচরণে ফুঁসে ওঠেন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা। এমতাবস্থায় খালেদ মোশারফ ও শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যূত্থান ঘটিয়ে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত এবং জিয়াকে গৃহবন্দী করেন।

ফলে রাতারাতি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা জাসদ গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা মিলে কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যূত্থান সংঘটিত করে এবং ‘সিপাহী জনতা ভাই ভাই/ অফিসারদের রক্ত চাই’ শ্লোগান দিয়ে দশম রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে অবস্থানকালে তিনজন কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে খালেদ মোশারফ, মেজর হায়দার, কর্ণেল হুদাকে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন কোম্পানি কমান্ডার আসাদ ও জলিল। উল্লেখ্য, দু’জনই ছিলেন কর্ণেল তাহেরের ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র সদস্য। এ তিনজন ছাড়াও ৭ নভেম্বর উচ্ছৃঙ্খল সেনারা মহিলা ডাক্তার ক্যাপ্টেন হামিদা এবং একজন সেনা অফিসারের স্ত্রীসহ আরও ১৪জনকে হত্যা করেন।

এরপর কর্নেল তাহেরের অনুগতরা গৃহবন্দী থেকে জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেন। যে কর্ণেল তাহের জিয়াকে নতুন প্রাণ দান করেন, সে তাহেরকে ৭ নভেম্বরের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই সামরিক আদালতের প্রহসনের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁর প্রাণ দানের প্রতিদান দেন জিয়াউর রহমান। এছাড়া বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ অফিসার ও জওয়ানকে কোর্ট মার্শালের প্রহসনের বিচারে রাতের অন্ধকারে ফাঁসি দেয়া হয় এবং তাঁর দল জাসদকেও এমনভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয় যে, এ দল এখনও পর্যন্ত আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।

জিয়াকে বিশ্বাস করার কারণে নাহয় তাহের ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফ কেন ব্যর্থ হলেন ? কী ছিল তাঁর উদ্দেশ্য ? তা নিয়ে বিভিন্ন সামরিক বিশ্লেষকরা ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছেন।

মূলত খালেদ মোশারফের সমন্বয়হীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অকারণে বিলম্ব, অদূরদর্শিতা আর নমনীয়তা, রক্তপাতহীন অভ্যূত্থানের মনমানসিকতা, রাজনীতি সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার লোভ-লালসা, তখনকার প্রভাবশালী জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সরব তৎপরতা, গণমাধ্যম থেকে দূরে থাকা, সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকা, শত্রু বা প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে সামরিক গোয়েন্দাদের ব্যবহার না করার কারণে শত্রুপক্ষের বিষয়ে অন্ধকারে থাকা, আওয়ামীলীগের পক্ষে অভ্যূত্থান ঘটানো এবং ভারতীয় সেনার জুজুর ভয় দেখিয়ে অপপ্রচারই খালেদ মোশারফের অভ্যূত্থান ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ বলে সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। যার পরিণতিতে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয় খালেদ ও তাঁর সহযোগী হুদা-হায়দারকে। যদি সেদিন গণমাধ্যম ব্যবহার করতেন, তাহলে জেল কর্তৃপক্ষ জানতেন যে, বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশতাকের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যূত্থান হয়েছে। তাহলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতো এবং চার জাতীয় নেতা বেঁচে যেতেন।

এছাড়াও জিয়াউর রহমানের অনুসারী ও ফারুক-রশীদ চক্রের অনুগত সেনা, মোশতাকের অনুগতদের সম্পর্কে খালেদ কোনো পদক্ষেপ নেননি। খালেদ সরল মনে সবাইকে বিশ্বাস করে নিজ লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এ পথে চলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তাঁর পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল, তা তিনি খেয়ালই করেননি। খালেদের সংগঠিত এসব শত্রুরা ছিলেন অনেক নিষ্ঠুর, যা আমরা পরবর্তীতে দেখেছি।

এ বিষয়ে লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি তাঁর ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ গ্রন্থে লিখেছেন, “খালেদ বরাবরই ছিলেন একজন দক্ষ ও প্রতিভাবান অফিসার। কিন্তু ঐ মুহুর্তে তিনি যারপর নাই অদক্ষতার পরিচয় দেন, যার ফলাফল তার পক্ষে মারাত্মক হয়। বারবার প্রশ্ন জাগে, অভ্যুত্থানের নায়ক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ একটি নাজুক মুহুর্তে তার তুচ্ছ প্রমোশনের জন্যে এভাবে খোন্দকার মোশতাকের পেছনে কেন নতজানু হয়ে ছোটাছুটি করলেন। এরকম অদক্ষতার পরিচয় খালেদ জীবনে আর কোনোদিন তার কর্মক্ষেত্রে দেখাননি। একজন ক্ষমতাধর সেনানায়ককে কিভাবে প্রমোশন নিতে হয়, ঐদিনই কিছুক্ষণ পর কর্নেল শাফায়েত জামিল বঙ্গভবনে প্রবেশ করে দেখিয়ে দিলেন।”

খালেদ মোশারফ সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার জন্য এতই বিভোর ছিলেন যে, ৩ নভেম্বর জেলখানায় চার জাতীয় নেতার নির্মম মৃত্যুর কথা তিনি ৪ নভেম্বর সকাল ১০টা পর্যন্ত জানতেন না এবং এ সময়ের মধ্যে তাঁর সঙ্গে দেন-দরবার করে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা চার্টার বিমানে বউ-বাচ্চা নিয়ে ব্যাংককে চলে যান। যার ফলে তাঁর পতন দ্রুত তিনি নিজেই ডেকে আনেন। সামরিক অভ্যূত্থানের ইতিহাসে কোনো অভ্যূত্থানকারী সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি করেননি। সামরিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন, খালেদ মোশারফ সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নিয়েছেন, কিছুক্ষেত্রে অযথা সময় নষ্ট করেছেন। যা তার অভ্যূত্থানকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।

বর্তমান সময়ের বিখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণও একই কথা বলেন। তিনি তাঁর ‘রক্তাক্ত নভেম্বর ১৯৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন, “আমার মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি সামরিক বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার সীমিত লক্ষ্যকে সামনে রেখেই খালেদ মোশারফ এই অভ্যূত্থান ঘটিয়েছিলেন ? দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপটু একজন দুর্বল চিত্তের জেনারেল হিসেবে খালেদ যখন চিহ্নিত হতে চলেছেন, তখন আমাদের কানে আসে শাফায়াত জামিলের নাম। আমরা শুনতে পাই, শাফায়াত জামিল বঙ্গভবনে গিয়ে খুনি মোশতাককে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন জেনারেল ওসমানী সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে মোশতাককে রক্ষা করেন-এমন কথা শোনা যাচ্ছিলো।”

এছাড়াও ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য এক শোক র‌্যালিতে খালেদ মোশারফের মা ও ভাই যোগ দেয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। ফলে বিরোধী পক্ষ তাঁকে ভারতপন্থী এবং আওয়ামীলীগপন্থী বলে অপপ্রচার চালায়। যদিও তিনি পুরোপুরি ভারতবিরোধী ছিলেন এবং আওয়ামীলীগকেও সমর্থন করতেন না।

মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি তাঁর ‘পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ’ গ্রন্থে লিখেছেন, “খালেদ যে কখনই আওয়ামীলীগ সমর্থক ছিলেন না তার বড় প্রমাণ মুক্তিযুদ্ধকালে তার কার্যকলাপ প্রবাসী সরকারের মনোপুত ছিল না। খালেদ নক্সালপন্থীদের অস্ত্র দিচ্ছিলেন, যা আওয়ামীলীগ বা ভারতের কাম্য ছিল না।”

তিনি আরও লিখেছেন, “স্বাভাবিকভাবেই খালেদের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন জাগেঃ তিনি যদি মুজিবপন্থী অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিতেন তাহলে প্রথম সুযোগেই জেল থেকে আওয়ামীলীগ নেতাদের মুক্ত করে সরকার গঠন করতেন। তিনি তা করেননি বরং মুজিব হত্যাকান্ডের হোতা মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত রেখেছিলেন। শুধু এই নয়, যেসব মেজরগণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে খালেদ তাদেরকে নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন।”

বইটির আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “খালেদ মোশারফ জেলে নিহত চার নেতাকে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণেও সমাহিত করতে সম্মতি দেননি। আসলে খালেদ মোশারফ বিধিবহির্ভূতভাবে সেনাপ্রধান হতে গিয়েই ভেতরে ভেতরে অনেক বিপত্তি ঘটান। সেনাপ্রধানের র‌্যাংক পরার পর উল্লসিত খালেদ বুঝতে পারেননি তার একটি ভুল বড় এক বিপদ ডেকে নিয়ে আসছে।”

খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থান ছিল রক্তপাতহীন। খালেদ কোনো রক্তপাত চাননি। কিন্তু তিনি তাঁর শত্রু সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। তাঁর কাছে ছিল না যথাযথ গোয়েন্দা তথ্য। জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর ‘বাংলাদেশ, এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে লিখেছেন, “১৯৭৫ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে ছড়ানো হলো হাজার হাজার প্রচারপত্র। এ কাজগুলো করলো বামপন্থী জাসদ। এ সময় রাজনৈতিক দল জাসদ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু এরা কাজ করছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর আবরণে। কর্ণেল তাহের ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান সফল করে জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন।

৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূলে ছিল জাসদের সশস্ত্র শাখা। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানই খালেদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। রক্তপাত হলে সমসাময়িক সময়েই আরব্য রজনীর গল্পের মতো বদলে যেতো ইতিহাস। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তপাত আর নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড শুরু হলো। এ দিনেই, জিয়া ও তাহেরের নির্দেশে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বীর সেনানী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফকে বীরউত্তম, কর্নেল এটিএম হায়দার বীরউত্তম ও কর্নেল নাজমুল হুদা বীরবিক্রম, সেনা অফিসার, সিপাহীসহ আরো অসংখ্য নারী-পুরুষকে। জাসদের গণবাহিনী ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একের পর এক সামরিক অফিসারদের নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকে।”

সুতরাং চৌকষ, অদম্য ও অনন্য দুই কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের মহাভুলের ফসল বিয়োগান্তক ৭ নভেম্বরের সৃষ্টি। মূলত দিনটি ছিল ক্ষমতার লড়াইয়ের দিন এবং এ ক্ষমতার লড়াইয়ে দেশি-বিদেশি শত্রুপক্ষের সুপরিকল্পিত পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে নিহত হন।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।