পূর্ণি ঘোষাল


কবি গুরু গেয়েছিলেন- ‘আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও মনের কোনের সব দীনতা, মলিনতা ধুইয়ে দাও আমার পরাণবীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃত গান তার নাই-কো বাণী, নাই-কো ছন্দ, নাই-কো তান তারে আনন্দের এই জাগরণে ছুঁইয়ে দাও...’ দিওয়ালী বা দীপাবলী উৎসব মূলত ‘ফেস্টিভ্যাল অব লাইট’ নামে পরিচিত হলেও, ধর্মীয় দিক বিবেচনায় দিওয়ালীর মূল অর্থ হচ্ছে, ‘অন্তরের আলো’ বা আত্মার উজ্জ্বলতা।

হিন্দু দর্শনের মূল কথাই হচ্ছে, দেহ ও মনের আড়ালে যা থাকে, তার নাম অন্তর বা আত্মা, যা অসীম, অবিনশ্বর এবং বিশুদ্ধ। সেই অন্তরের আলো জ্বালতে পারলেই শুভবুদ্ধির জয় হয়, অশুভ শক্তি পরাজিত হয়। মূর্খতা, অজ্ঞতা, হিংসা, ঈর্ষা, দ্বেষ, লোভ, অহঙ্কার, চৌর্যবৃত্তির মত অন্ধকারে যখন ঢাকা থাকে মানুষের অন্তর, তখনই মানুষের নৈতিক স্খলন ঘটে, হানাহানি, মারামারি, যুদ্ধ, ঝগড়া-বিবাদে মানুষ লিপ্ত হয়। এ সকল অশুভ রিপুর তাড়নে মানুষের প্রকৃত অন্তর আড়ালে থেকে যায়। এই সমস্ত অশুভ আড়াল কেটে যখন মানুষের বিবেক জাগ্রত হয়, তখনই সত্যের জয় হয়। মানুষ তার নিজের আত্মাকে খুঁজে পায়, অজ্ঞতা কেটে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে, জ্ঞান বিকাশের এই অনুভূতির আরেক নাম আনন্দ বা শান্তি।

যদিও গোষ্ঠী, জাতি, বর্ণ, স্থান বিশেষে ‘দিওয়ালী’ বিভিন্ন আঙ্গিকে উদযাপিত হয়, উৎসবের মূলবাণী এক অন্তরের আলোয় দেখা, অন্তরের আলোকে দেখা। উৎসবের ইতিকথা ইতিহাস অনুযায়ী, এই আলো ঝলমলে দিওয়ালীর উৎপত্তিটা হয়েছিল কৃষিনির্ভর প্রাচীন ভারতে। হাজার বছর আগে তখন এটা ছিল খুব সম্ভবত ফসলের উৎসব। তখনকার লোকেরা ঋতুপর্ব উদযাপনের মাধ্যমে এ উৎসবের শুরু করেছিল। এ সময় ফসল কাটা, মাড়াই করা ও গোলাজাত করার কাজ শেষ হয়ে যেত। ফলে কাউকে আর বছরের বাকি দিনগুলোর খাবারের ভাবনায় উদ্বিগ্ন থাকতে হতো না। অগণিত কুপিবাতি জ্বেলে তারা এই আনন্দ প্রকাশ করত। কিন্তু দিওয়ালীর আসল উৎপত্তিগত বিষয়ে প্রচলিত আছে নানা লোকগাঁথা। সময়ের স্র্রোতের ধারায় অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাও যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে। আর পুরাণে বর্ণিত আছে নানা আখ্যান। অনেকে মনে করেন, দেবী লক্ষ্মী ও প্রভু বিষ্ণুর বিবাহ উদযাপনের জন্যই এ উৎসব।

পক্ষান্তরে অনেকের ধারণা, শক্তির কৃষ্ণাভ দেবী কালীর অর্চনায় এই উৎসব উৎসর্গীকৃত। রাবণের পরাজয় ও চৌদ্দ বছর নির্বাসন শেষে প্রভু রামের প্রত্যাবর্তনের স্মরণার্থে দিওয়ালী পালন করা হয়, এ বিশ্বাসও অনেকেরই। অন্যদিকে জৈনধর্মমতে, প্রভু মহাবীরের স্বর্গীয় আশীর্বাদ লাভের ঘটনার মধ্যেই এ উৎসবের তাৎপর্য নিহিত। ‘ধনতেরাস’ ও দেবী লক্ষ্মীর আবির্ভাব পাঁচ দিনব্যাপী এ উৎসবের শুরু হয় অশ্বজা বেহুলা চতুর্দশীতে ও শেষ হয় কার্তিক শুদ্ধ বিজয়ায়। প্রথম দিনকে বলা হয় ‘ধনতেরাস’ বা ‘ধনত্রয়োদশী’। উপকথা অনুসারে, এদিন দেবতা ও অপদেবতাদের সমুদ্র-মন্থনের সময় সমুদ্র থেকে উত্থিত হন ধনভা-ারী। সঙ্গে করে নিয়ে আসেন অমৃতের পাত্র। ‘ছোট দিওয়ালী’ ও পিশাচ দেবতা নরকাশুর নেপালের দক্ষিণে অবস্থিত প্রাগজ্যোতিশপুর প্রদেশের শাসক ছিল অপদেবতা নরকাশুর। এই অপদেবতা রাজ্যে অতিশয় অশান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। সুশ্রী যুবতী মেয়েদের সে অপহরণ করে নিয়ে যেত ও সম্ভ্রমহানি করার চেষ্টা করত। একটি যুদ্ধে সে প্রভু ইন্দ্রকে পরাজিত করে ও দেবী অদিতির কানের গহনা লুট করে নিয়ে যায়। এছাড়া সাধুদের ষোলো হাজার কন্যাকে সে তার হারেমে জোরপূর্বক বন্দী করে রাখে। অবশেষে বন্দীবাসিনীদের আর্ত-চিৎকারে অবতরণ করলেন প্রভু বিষ্ণু। কৃষ্ণের রূপ ধারণ করে প্রভু বিষ্ণু নরকাশুরের সঙ্গে লড়াই করলেন। নরকাশুরকে হত্যা করে কন্যাদের মুক্ত করলেন আর উদ্ধার করলেন দেবী অদিতির কানের অলঙ্কার। এই পিশাচ দেবতা নরকাশুরের পরাজয়ের আনন্দে দিওয়ালীর দ্বিতীয় দিনে পালন করা হয় ‘নরক চতুর্দশী’। এদিনকে ‘ছোট দিওয়ালী’ও বলা হয়। এদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে আকাশে তারা দেখা যায় এমন সময়ে স্নান করা পবিত্র গঙ্গাস্নানের সমতুল্য বলে বিশ্বাস করা হয়। ‘কার্তিক শুদ্ধ পদ্যমী’ ও রামের প্রত্যাবর্তন কার্তিক অমাবস্যার এ দিনকে দিওয়ালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অমাবস্যায় প্রভু রাম ও সীতাকে নিয়ে কাহিনী বর্ণিত আছে পুরাণে। অযোধ্যার রাজককুমার রাম ছিলেন সাহসী এক যোদ্ধা। তাঁর পিতা ছিলেন রাজা দশরথ। পিতার নির্দেশ অনুযায়ী সস্ত্রীক নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন রাম। অন্যদিকে লঙ্কার রাজা রাবণ ছিল সুদক্ষ এক পণ্ডিত। কিন্তু সে তার দীক্ষাকে সর্বদা অপকর্মে ব্যবহার করত। এই অপদেবতা রাবণ জঙ্গল থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সীতাকে। প্রভু রাম তখন লঙ্কা আক্রমণ করেন ও রাবণকে হত্যা করে সীতাকে উদ্ধার করেন। অবশেষে চৌদ্দ বছরের নির্বাসন শেষে স্ত্রী সীতা ও ভাই লক্ষণসহ অযোধ্যায় ফিরে আসেন রাম। অযোধ্যার লোকেরা প্রিয় রাজকুমারকে কাছে পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। পুরো নগরীতে দ্বীপ জ্বেলে, আলোক প্রজ্বলন করে অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির এই বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করে তারা। দিওয়ালীর এই দিনটি ‘কার্তিক শুদ্ধ পদ্যমী’ নামে পরিচিত। এই দিনটিকে ‘বালি পদ্যমী’ ও বলা হয়। অমাবস্যার এই দিনেই প্রভু বিষ্ণু বালির রাজাকে পরাভূত করে তাকে পাতালে নির্বাসিত করেন। এ ছাড়া এ অমাবস্যার রাতে পঞ্চপা ব যুধিষ্ঠির, ভিম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের কাহিনীর উল্লেখ আছে মহাকাব্য মহাভারতে। ‘যামী দ্বিতীয়া’ বা ভাইডুজ দিওয়ালীর শেষের দিনকে বলা হয় ‘যামী দ্বিতীয়া’। ভাই ও বোনের সম্পর্কের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোই এ দিনের প্রথা। পুরাণ অনুসারে, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষ দ্বিতীয়ার দিনে বোন যমুনাকে দেখতে যান প্রভু যমরাজ। যমুনা তাকে আরতির মাধ্যমে সম্ভাষণ জানান। এ ছাড়া কপালে তিলক এঁকে দিয়ে ও গলায় পুষ্পমালা পরিয়ে ভাইকে বরণ করেন যমুনা। তাকে আপ্যায়ন করা হয় বিভিন্ন সুস্বাদু ও মিষ্টিজাত খাবারের ভোজ দিয়ে। বোনের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যমরাজ বোনকে আশীর্বাদ দিয়ে যান। এখান থেকেই প্রচলন হলো ‘যামী দ্বিতীয়া’র।

দিওয়ালীর এই দিনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাই ও বোনেরা একে অন্যের খোঁজখবর নেন, পারস্পরিক মমত্ববোধের পরিচয় দেন। এ দিনটিকে ‘ভাইডুজ’ ও বলা হয়ে থাকে। শিখ সম্প্রদায় ও জৈন ধর্মানুসারীদের দিওয়ালী শিখ সম্প্রদায়ের জন্য এ উৎসব বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ সময় তাদের ষষ্ঠগুরু গুরু হরগোবিন্দ জি গোয়ালিয়র শহরের দুর্গের বন্দিত্ব থেকে মুক্তিলাভ করেন। এ সম্প্রদায়ের লোকেরা এ সময় ‘সোনালি মন্দির’ নামে পরিচিত শ্রী হরমানধীর সাহেবের পথে আলোকসজ্জার আয়োজন করে।

জৈন ধর্মানুসারীদের কাছেও দিওয়ালী অশেষ তাৎপর্যম-িত। এ সময়ই তাদের জৈনগুরু ভগবান মহাবীর মোক্ষলাভ করেছিলেন। ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণনির্ভর উপকথায় কিঞ্চিত ভিন্নতা থাকলেও দিওয়ালীর সারমর্ম কিন্তু অভিন্ন। মূলত তা অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির বিজয়কেই নির্দেশ করে। প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য এ এক অপার আলোর উৎসব। এ আলো ভেতরের ও বাইরের। এ সময় বাতাসে ধুপের গন্ধ ছড়ায়, পটকাবাজির শব্দে চারদিকে ধ্বনিত হয়, আলোর বন্যায় রঙিন হয় চারপাশ। তেমনি অন্তর্লোকের শুদ্ধতম আলোকচ্ছটায় অকল্যাণকর যত অন্ধকারকে দূরীভূত করার বার্তা নিয়ে আসে দিওয়ালী।

লেখক : সংবাদকর্মী।