সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া : গুলি খাইয়্যা আমার পুত জালাল মইর‌্যা গিয়া সব শেষ অইয়্যা গেছে। এহন কে আমরার সংসার চালাইব, কে দিব আমারে ওষুধ কিনার টেহা, নাতিডারে ভাত কাপড় দিয়্যা কে লালন পালন করব, কি অইব আমার পুতের বউ নার্গিসের ইত্যাদি কথা বলে রাত থেকে বিলাপ করতে করতে ক্লান্ত অবশন্ন হয়ে পরেছেন গুলিতে নিহত পোশাক শ্রমিক জালাল উদ্দিনের বৃদ্ধ মা জাহেরা খাতুন। আজ রবিবার দুপুরে গিয়ে জালালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শোকাহত মানুষের আনাগোনা।

চোখে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। এছাড়া গাড়ের হাড় ক্ষয়, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত জাহেরা খাতুন। পোশাক শ্রমিক ছেলে জালাল উদ্দিনের মৃত্যুর খবর যেন তার মাথায় বজ্রাঘাতে জীবন শেষ হওয়ার মতো আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা। এ মৃত্যু যেন জালালের মা, স্ত্রী, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কেউই মেনে নিতে পারছিলেন না। শনিবার রাত থেকেই দলে দলে মানুষ এসে জালালের বাড়িতে ভীড় জমায়। জালালের মায়ের করোন আর্তনাথ শুনে সবাই চোখেল জল মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বিদায় হয়।

কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গড়ডোবা ইউনিয়নের বাশাটি গ্রাম। এই গ্রামের চাঁন মিয়া ছেলে জালাল উদ্দিন। চাঁন মিয়া দুটি সংসার করেছিলেন। বর্তমানে ছোট স্ত্রী জাহেরা খাতুন জালালের মা। জালালের বাবা চাঁন মিয়া এক স্ত্রী, চার ছেলে ও দুই কন্যা সন্তান রেখে মারা যান। ২য় স্ত্রী জাহেরা খাতুনের তিন সন্তানের মধ্যে জালাল সবার বড়। জালালই সংসার পরিচালনা করতেন। অর্থের অভাব মেটাতে আত্মীয়স্বজনদের সাহযোগিতায় ছোট ছেলে সাইফুল প্রবাসে দুবাই থাকেন। কন্যা সুলতানা রাজিয়া পুষ্প স্বামীর বাড়িতে আছেন।

অপর দিকে চাঁন মিয়ার বড় স্ত্রী কুলসুমা আক্তারেরও দুই ছেলে ও এক কন্যা বড় ছেলে আব্দুস ছালাম ও ছোট ছেলে সাইফুল ইসলাম জুসনা তারা আলাদা সংসারে থাকেন। ছোট কন্যা আঙ্গুরাও স্বামীর বাড়িতে থাকে।

অভাব অনটনের সংসারে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলিগরে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে প্রায় ১২ বছর আগে জালাল উদ্দিন গাজীপুরের কোনাবাড়ী জরুন এলাকায় ইসলাম গার্মেন্টসে চাকরিতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন গড়ডোবা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড যুবলিগের সভাপতি। চাকুরিতে ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করায় প্রমোশন পেয়ে সবশেষে তিনি সুপারভাইজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর সেখানেই স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন জালাল। তার রয়েছে ৯ বছরের এক কন্যা সন্তান। স্ত্রী নার্গিস আক্তার গৃহের কাজ সামলাতেন পৌতৃক জমাজমি বসতবিটাসহ যেটুকু আছে তা দিয়ে কোন মতেই সংসার চলে না। তাই গামেন্টেসের চাকরির পয়সা দিয়েই স্ত্রী সন্তান ও তার মা ও ভাইদের ভরণ পোষণ করতেন জালাল।

জানা যায়, গত ৮ নভেম্বর বুধবার সকালে তিনি প্রতিদিনের মতো গার্মেন্টেসে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন গার্মেন্টস তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। পরে সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে গুলিবৃদ্ধ হন তিনি। জালাল উদ্দিনের চাচাতো ভাই আশিকুর রহমান জানান শুনেছি পেটের বামপাশে ও হাতে পায়ে গুলি লেগে আহত হয়েছিলেন। পরে তাকে স্থানীয় পপুলার ডায়াগানোস্টিক সেন্টারে নেওয়া হলে সেখান থেকে ওই দিনেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক থাকায় নিবির পরিচর্যা করার জন্য সেখানে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন। গড়াডোবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানর কামরুজ্জামান খান সোহাগ বলেন তার শূন্যতা পূরণ হবেনা। জালাল উদ্দিনেই ছিলেন এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যাক্তি। তিনি খুব ভালো এবং মিশুক মানুুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে আমরা সারা এলাকাবাসী শোকাহত। বর্তমান সরকারের মানবিক প্রধানমন্ত্রী যদি এই পরিবারটির দিকে সুদৃষ্টি দেন তাহলে পরিবারের সদস্যরা মোটা কাপড় মোটা ভাত খেয়ে দিন যাপন করতে পারবেন।

জালাল উদ্দিনের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বাড়িতে আনা হবে সে অপেক্ষায় রয়েছে শত শত মানুষ। বাড়ির সামনে কূড়ে রাখা হয়েছে কবর। আশিকুর রহমানসহ গ্রামের মুরুব্বিগণ বলছিলেন রাতে লাশ আসার পর নামাজের যানাজা শেষে রাতেই দাফন কাফন করা হবে। তবে এই রকম একটা মৃত্যু আমরা কেউই দেখতে চাইনি। পরিবারটিকে পুনর্বাসনের জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি।

(এসবি/এসপি/নভেম্বর ১২, ২০২৩)