ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


১৭ নভেম্বর (শুক্রবার) বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবস ২০২৩। বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে অপরিণত নবজাতকজনিত জটিলতায় সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায়, বাংলাদেশ তার একটি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন নবজাতক শিশুর অপরিণত জন্মজনিত জটিলতায় মারা যায়। নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে অপরিণত ও কম ওজনের শিশুকে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।  

বাংলাদেশে বছরে প্রায় ছয় লাখ শিশু অপরিণত বা প্রিম্যাচিওর বেবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৫০ লক্ষ প্রিম্যাচিওর শিশু জন্ম নেয়। প্রতি দশটি নবজাতকের মধ্যে একটি নবজাতক সময়ের আগেই অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। বিশ্বব্যাপী, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ প্রিটার্ম বার্থ এবং প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ শিশু শুধুমাত্র অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেবার কারণে মারা যায় প্রিম্যাচিওর বাচ্চার জন্ম, জন্ম সংক্রান্ত এবং জন্ম পরবর্তী জটিলতা নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই মূলত ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচ্যুরিটি ডে পালন করা হয়।

প্রিম্যাচিওর বেবি বা অপরিণত শিশু বলতে কি বোঝায়?

দিনটি সম্পর্কে জানার আগে আসুন দিনটি কাদের জন্য সেই সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক। প্রথমেই আসি, প্রিম্যাচিওর বেবি কারা। দুইভাবে এটির ব্যাখ্যা দেয়া যায়-

৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেয়া সকল বাচ্চাকে প্রিম্যাচিওর বা অপরিণত শিশু বলা হয়।

আবার EDD বা এক্সপেক্টেড ডেলিভারি ডেটের ৩ সপ্তাহ বা তার বেশি আগে কোনো শিশু জন্ম নিলে তাকেও প্রিম্যাচিওর বলা যাবে।

প্রিম্যাচুরিটি ডে এবং তার ইতিহাস

বিশ্বব্যাপী, প্রতি বছর ১৭ই নভেম্বর ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচ্যুরিটি ডে বা বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবস হিসেবে পালিত হয়।

নবজাতক শিশুদের যত্নের জন্য ইউরোপীয় ফাউন্ডেশন (EFCNI) এবং অংশীদারিত্বকারী ইউরোপীয় অভিভাবক সংস্থাগুলি ২০০৮ সালে এই দিনটি পালন করার ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেয়৷ বিশেষ করে এই দিনটিকে বেছে নেয়া হয়, কারণ এই দিনে EFCNI এর একজন ফাউন্ডিং মেম্বার একটি কন্যা সন্তানের বাবা হন যিনি কিনা আগে প্রিম্যাচুরিটি সংক্রান্ত জটিলতায় নিজের সন্তানকে হারিয়েছেন।

মূলত প্রিম্যাচুরিটি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা এবং প্রিম্যাচিওর শিশু আছে এমন পরিবারগুলোর মধ্যে একাত্মতা তৈরি করার জন্য ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ১৭ই নভেম্বর দিনটি ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচুরিটি ডে হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

দিনটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

মাত্র ১২ বছর আগে দিনটি উদযাপন শুরু হলেও এরই মধ্যে বিশ্বের ৬০ টিরও বেশি দেশে দিনটি পালিত হচ্ছে৷ প্রতি বছর আরো নতুন নতুন দেশ এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে দিনটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ।

এর প্রথম কারণ হচ্ছে, দিন দিন প্রিম্যাচিওর শিশুর জন্মহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রিম্যাচিওর বাচ্চার সংখ্যা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু শিশুর জন্ম হয় সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বাবা মাসহ পরিবারের সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সময়ের আগেই সিজারিয়ান সেকশন করা হয়৷ ইদানীং বাংলাদেশে এই ধরনের সিজারিয়ান সেকশন অহরহ হচ্ছে। এক্সপেক্টেড ডেট আসার আগেই সময় সুবিধা মত দুই এক সপ্তাহ আগেই বাচ্চা বের করা হচ্ছে। ফলাফল, প্রিম্যাচুরিটি এবং সে সংক্রান্ত জটিলতা। সাধারণভাবে একটি শিশু ৩৮ থেকে ৪২ সপ্তাহের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে। জন্ম ৩৮ সপ্তাহের আগে এবং ওজন ১ হাজার ৫০০ গ্রামের কম হলে তাকে প্রিম্যাচিউর বা অপরিপক্ব নবজাতক বলা হয়।

মোটামুটি ৩৪ থেকে ৩৭ সপ্তাহ হলে বাচ্চাকে লেট প্রিটার্ম বেবি বলা হয়। এক্ষেত্রে জন্ম পরবর্তী জটিলতা অপেক্ষাকৃত কম হয়। তবে বাচ্চা যদি ৩২ সপ্তাহ বা তার থেকেও আগে জন্মগ্রহণ করে, তবে হার্ট, লাংস, ব্রেইন এবং ভিশন বা দৃষ্টিশক্তি জনিত নানা সমস্যা দেখা দেয়। অনেকের লার্নিং ডিজ্যাবিলিটি, শ্রবণশক্তি কম হবার মত সমস্যাও হতে পারে।

উন্নত বিশ্বে ২৫ কিংবা ২৬ সপ্তাহের মাইক্রো প্রিমি শিশু বাঁচানোর নজির রয়েছে৷ তবে বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই এই সুবিধা নেই। কিংবা থাকলেও রাজধানী বা দেশের বড় বড় দুই একটি শহর ছাড়া প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং অপরিণত শিশুর 'প্রাইমারি কেয়ার' দেবার মত দক্ষ জনবল নেই।

স্ক্রিনিং

আরওপি রোগটি শিশুর জন্মের সময় থাকে না। শুধু জন্ম আগে হওয়ার কারণে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে রোগটি হয়ে থাকে। এ কারণে আরওপির স্ক্রিনিং ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে করতে পারলে সব থেকে ভালো। কারণ এটি এত দ্রুত বৃদ্ধি পায় যে একটু দেরি করলে শিশুর সমূহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।মনে রাখতে হবে, যেসব নবজাতকের জন্ম ৩৫ সপ্তাহের আগে এবং যাদের ওজন ২ হাজার গ্রামের কম, তাদের রেটিনা অবশ্যই ৩০ দিনের মধ্যে এবং যেসব নবজাতকের জন্ম ২৮ সপ্তাহ আগে এবং যাদের ওজন ১ হাজার ২০০ গ্রামের কম, তাদের রেটিনা অবশ্যই ২০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করতে হবে।

কেন অপরিণত শিশুর জন্ম হয়?

ঠিক কি কারণে প্রত্যাশিত সময়ের আগেই শিশুর জন্ম হয়, তার সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে এর কিছু কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে-

* ডায়বেটিস * মায়ের উচ্চ রক্তচাপ * মাল্টিপল প্রেগনেন্সি * ভ্যাজাইনাল সংক্রমণ * ধূমপান* স্ট্রেস ইত্যাদি।

এছাড়াও মায়ের দারিদ্র্যজনিত অপুষ্টি, মদ্যপান, জরায়ুর গঠনগত অস্বাভাবিকতা, UTI বা মূত্রনালীর সংক্রমণ জনিত কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম হতে পারে।

প্লাসেন্টার বিভিন্ন সমস্যা যেমন প্লাসেন্টা প্রিভিয়া এবং অ্যাবরাপসিও প্লাসেন্টাতেও প্রিটার্ম শিশুর জন্ম হতে পারে৷

প্রিম্যাচিওর শিশুর সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতাগুলি কি কি?

৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া শিশুর বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতা হতে পারে। যেমন :_* শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া * কম ওজন * শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকা * বাচ্চা মায়ের বুকের দুধ খেতে না পারা * খিঁচুনি * ফ্যাকাশে বা হলদেটে চামড়া * হার্ট ফেইলিওর * ডিহাইড্রেশন
* রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচুরিটি এছাড়াও ব্রেইন হেমোরেজ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, পালমোনারী হেমোরেজ বা ফুসফুসে রক্তক্ষরণ, হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত কম শর্করা, নিউমোনিয়া, অ্যানিমিয়া, রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম (RDS) সহ জীবন সংশয়কারী বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।

কিভাবে অপরিণত শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করা যেতে পারে?

নবজাতকের মৃত্যু এবং অপরিণত জন্ম থেকে সৃষ্ট জটিলতা প্রতিরোধ একজন মায়ের সুস্থ গর্ভাবস্থার মাধ্যমে শুরু হয়।

প্রাইমারি কেয়ার

বিভিন্ন রকম রিস্ক ফ্যাক্টর যেমন ডায়বেটিস, ইনফেকশন, প্রি একলাম্পসিয়া, ডায়রিয়া, এনিমিয়া, লো বিএমআই এসব সমস্যা গর্ভবতী মায়েদের আগেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

* সেকেন্ডারি কেয়ার

নিয়মিত মায়ের স্ক্রিনিং টেস্ট করতে হবে। যেন কোনো সমস্যা থাকলে সেটা আগেই ধরা পড়ে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়। অনেক সময় টকোলাইটিক এজেন্ট ব্যবহার করে জরায়ুর সংকোচনশীলতা কমানো সম্ভব হয়। এভাবে টকোলাইটিক ব্যবহার করে ৩ দিন বা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করা যায়।

* টারশিয়ারি কেয়ার

অনেক সময় গর্ভকালীন শিশুর লাং ম্যাচুরিটি অর্থাৎ ফুসফুসকে পরিণত করার জন্য কর্টিকোস্টেরয়েড দেয়া হয়। এর ফলে রেসপিরেটরি ডিসট্রেস এবং ইন্টার ভেন্ট্রিকুলার হেমোরেজ হবার সম্ভাবনা কমে যায়।

ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচ্যুরিটি ডে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করবেন যেভাবে

বাংলাদেশে এই দিনটি নিয়ে এখনো ততটা আলোচনা চোখে পড়ে না। তবে দেশের অনেক হাসপাতাল, এনজিও এবং হেলথ অর্গানাইজেশন দিনটিকে বিশেষ ভাবে পালন করার জন্য নানা রকম ইভেন্ট, ক্যাম্পেইন এবং সেমিনার আয়োজন করে।

হোমিও সমাধান

শিশুদের সমস্যার জন্য একটি উন্নত এবং নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি হলো হোমিওপ্যাথি। প্রপার একটি হোমিও চিকিৎসায় এই ধরণের শিশুদের স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। তবে এর জন্য অভিজ্ঞ একজন হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে চিকিৎসা নেয়া জরুরী অন্যথায় ভাল ফলাফল আশা করা দুস্কর। এক্ষেত্রে হোমিও চিকিৎসকগণ শুধুমাত্র উপরি উপরি দিক চিন্তা করেই চিকিৎসা প্রদান করেনা না কারণ এর পেছনে থাকে PTS, PRS এবং পিতা-মাতা বা পূর্ব পুরুষ থেকে প্রাপ্ত দুরারোগ্য রোগের জেনেটিক মেটিরিয়াল। তাই এই ক্ষেত্রে শিশুর বর্তমান অবস্থা, পিতা-মাতা, দাদা-দাদী অর্থাৎ ফ্যামিলি হিস্ট্রি জেনে তার জেনেটিক্যাল অবস্থা বিচার বিশ্লেষণ পূর্বক চিকিৎসা শুরু করতে হয়। তখন নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এবং হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতি অনুসরণ করে একটি উন্নত চিকিৎসা দিলে শিশু দিন দিন উন্নতির দিকে যেতে থাকে এবং এক সময় সার্বিক একটি স্থায়ী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় যা হোমিওপ্যাথি ছাড়া অন্যকোন চিকিৎসা শাস্ত্রে সম্ভব হয় না। তাই অপরিণত শিশুদের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির সফলতা এবং ঝামেলামুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতিতে আকৃষ্ট হয়ে ক্রমেই এই চিকিৎসার প্রতি রুগীদের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরিণত শিশুদের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক গন প্রাথমিক অবস্থায় যে-সব মেডিসিন লক্ষণের উপর নির্বাচন করে থাকে রোগীর ‘মায়াজমের’ দিকে খেয়াল রেখে থুজা, মেডোরিনাম, সিফিলিনাম, টিউবারকুলিনাম, সোরিনাম, সালফার, ক্যালকেরিয়া কার্ব, ক্যালকেরিয়া ফস, ক্যালকেরিয়া ফ্লোর, কস্টিকাম, বেলেডোনা, ব্রায়োনিয়া, মার্কসল, ন্যাট্রাম-মিউর, ন্যাট্রাম-সালফ ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করে থাকে। তাই ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে, অপরিণত শিশুদের চিকিৎসায় অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করাই উত্তম।

পরিশেষে বলতে চাই, অপরিণত শিশুদের শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সংগ্রামও করতে হয়। তাদের সাথে সাথে পরিবারের সকলকেও জীবন যুদ্ধে সামিল হতে হয়। ভালোবাসার কমতি না থাকলেও অনেক সময় অভিভাবকরা ঠিক বুঝে পান না যে কি করবেন। বাড়ির পরিচর্যা, সামাজিক বিধি-নিষেধ, অতিরিক্ত ব্যয়, অবহেলা ইত্যাদি মিলিয়ে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জের ফলে পরিবারটি জন্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।

ভাষাগত সীমাবদ্ধতা তো আছেই, তারওপর শারীরিক অক্ষমতা সব মিলিয়ে এই জীবন সংগ্রাম নিষ্পাপ শিশুদের জন্য বড়ই কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সহানুভূতি, আধুনিক পরিবেশগত ব্যবস্থা, উন্নত মানসিকতা ইত্যাদির মাধ্যমে অপরিণত নবজাতকরাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে, এমনকি জয় করতে পারে বিশ্বকেও।


লেখক : চিকিৎসক ও কলাম লেখক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।