সাতক্ষীরায় বেপরোয়া অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : শনিবার ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের কামটা গ্রামে দুই নারীসহ একই সংখ্যালঘু পরিবারের ৪ সদস্যকে চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। অচেতন অবস্থায় ওই পরিবারের চার সদস্যকে সখিপুর স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
সখিপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও উপজেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার মন্ডল জানান, শুক্রবার দিবাগত রাতে খাবার খেয়ে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কামটা গ্রামের কৌশিক সেনগুপ্ত (৫৮), তার স্ত্রী মৌসুমি সেনগুপ্ত (৪৫), থাদেরবকাকা তপন সেনগুপ্ত (৬২) এবং কাকিমা নূপুর সেনগুপ্ত (৫০)। শনিবার ভোররাতের দিকে সংঘবদ্ধ লুটেরা দলটি তাদের বাড়িতে ঢুকে ঘরের মধ্যে থাকা খাবারে চেতনানাশক মিশিয়ে স্বর্ণালঙ্কার ও রক্ষিত নগদ টাকা লুটপাট করে নিয়ে যায়। সকালে প্রতিবেশিরা তাদেরকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সাকিব হাসান বাঁধন বলেন, রাতের খাবারের সাথে তাদের চেতনানাশক মেশানো হয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তারা। দু’জন পুরুষ ও একজন নারী ভিকটিমের আগে থেকেই হার্ট ডিজিস ও ডায়াবেটিস থাকায় বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। চার জনের মধ্যে তিনজন এখনও আশংকা মুক্ত নন। তিনি আরও বলেন, এধরনের ঘটনায় উচ্চ মাত্রায় চেতনানাশক দেয়ার ফলে ভিকটিমদের অক্সিজেন লেভেল কমে গিয়ে মৃত্যুও হতে পারে।’
প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, আশাশুনিসহ বিভিন্ন স্থানে গত দেড় মাসে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা কমপক্ষে ১২ টি পরিবারের সদস্যদের অচেতন করে লাখ লাখ টাকার মুল্যবান মালামাল, স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এরমধ্যে কেবলমাত্র দেবহাটা উপজেলাতেই ঘটেছে এরকম দুর্ধর্ষ পাঁচটি চুরির ঘটনা। সুকৌশলেই এ ধরণের ঘটনা ঘটালেও ওই চক্রের সদস্যরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
দক্ষিণ পারুলিয়ার উজ্জ্বল সরকার ও তপন বিশ্বাস বলেন,অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়স পরিবার গুলো নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার সহ সারাজীবনের সঞ্চিত সম্পদ তো হারাচ্ছেনই, সাথে সাথে লুটেরাদের দেয়া অতিমাত্রার চেতনানাশকে রীতিমতো মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ছেন প্রাপ্তবয়স্ক থেকে শুরু করে শিশু, কিশোর ও বয়োঃবৃদ্ধ সদস্যরা। উন্নত চিকিৎসায় শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়েও, ভিকটিমদের উচ্চ মাত্রায় দেয়া দুর্বৃত্তের চেতনানাশকের ঘোর কাটতেই সময় লাগছে ২ থেকে ৪ দিন পর্যন্ত। কোথাও কোথাও লুটেরারা বাড়িঘর থেকে নগদ অর্থ আর স্বর্ণালঙ্কার লুটের পর আনন্দ উদযাপনে ভিকটিম পরিবারের ফ্রিজ বা বাড়িতে রাখা ফল, মিষ্টি জাতীয় খাবারও খেয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এসব ঘটনায় দেবহাটা সহ আশপাশের থানা গুলোতে কয়েকটি মামলা হলেও, ভুক্তভোগীদের অনেকেই মামলা করতে পারেননি থানায়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, একই ধরনের লুটের ঘটনায় কিছু কিছু সময় থানায় একাধিক মামলা নিতে চায়না পুলিশ। ফলে লিখিত অভিযোগেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে তাদেরকে। সংঘবদ্ধ চক্রটিকে সনাক্ত করতে পারলে সবারই মালামাল উদ্ধার করা সম্ভব হবে উল্লেখ করে বাকি ভুক্তভোগীদের মামলা না করে কেবলমাত্র লিখিত অভিযোগ দিতে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়। যেকারনে মামলা ছাড়াই পুলিশের আশ্বস্ত্বতায় লুট হওয়া মালামাল উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মুখ চেয়ে রয়েছেন ভুক্তভোগীদের অনেকেই।
যেসব বাড়িতে সংঘবদ্ধ লুটের ঘটনা ঘটছে তাদের মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ব্যবসায়ী বা সংখ্যালঘু ধর্ণাঢ্য পরিবারই বেশি। গত দেড় মাসে দেবহাটা উপজেলার চাঁদপুরে এক মৎস্য ব্যবসায়ী, পারুলিয়াতে সরকারি খানবাহাদুর আহছানউল্লাহ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক মৃত্যুঞ্জয় কর্মকার, সখিপুরে আইডিয়াল কোচিং সেন্টারের পরিচালক ও কলেজ শিক্ষক এবাদুল ইসলাম, পারুলিয়ায় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মধূসুদন দাশ ও কুলিয়ায় হাজী কেয়ামউদ্দন মেমোরিয়াল মহিলা কলেজের প্রভাষক শফিউল আলমের বাড়িতে দুর্ধর্ষ লুটের ঘটনা ঘটায় দুর্বৃত্তরা। শফিউল আলমের বাড়ি লুটের পর লুটেরা চক্রের সদস্যরা তার বাড়ির উঠানে কাপড় বিছিয়ে বসে বাড়িতে রাখা ফল ও মিষ্টি খেয়ে যায় বলেও জানিয়েছেন এ প্রভাষক।’
দেবহাটা সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারি পুলিশ সুপার এস.এম জামিল আহমেদ বলেন, ‘সংঘবদ্ধ এ চক্রটিকে সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে। পাশাপাশি দেবহাটা ও আশাশুনি থানা এলাকায় বিশেষ অভিযান অব্যহত রয়েছে। ভিকটিমদের চিকিৎসা শেষে থানায় মামলা দায়ের করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা প্রতিরোধে প্রত্যেকটি পরিবারকে সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে রান্নার সরঞ্জাম ও রান্না করা খাবার প্রোটেক্টেড স্থানে রাখা এবং শোবার আগে অবশ্যই ঘরের দরজা-জানালা ভালভাবে বন্ধ করা সহ ফাকা যায়গা গুলো ঢেকে দেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
(আরকে/এএস/ডিসেম্বর ০৯, ২০২৩)