মাগুরা প্রতিনিধি : মাগুরার শালিখা উপজেলার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যাচাই-বাছাইসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের দ্বায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় বরাবরসহ দুর্নীতি দমন কমিশন, জেলা প্রশাসক, জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন,উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে এক আবেদন প্রেরণ করেছেন উপজেলার দীঘলগ্রামের অরবিন্দু মন্ডল নামের এক ব্যক্তি। শনিবার দুপুরে অরবিন্দু মন্ডল নামের ওই ব্যক্তি সাংবাদিকদের নিকট অভিযোগের অনুলিপি প্রেরণসহ বক্তব্য দেন।

লিখিত অভিযোগে বর্নীত দেশে আগাছার মতোই বৃদ্ধি পাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা। যোগ হচ্ছে নতুন-নতুন মুক্তিযোদ্ধাও। শালিখা উপজেলায়ও থেমে নেই এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধিতে। কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা,আর কে মুক্তিযোদ্ধা নয় তা নিয়ে জন মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি এ সকল কথিত মুক্তিযোদ্ধারাও সরকার প্রদত্ত সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। তেমননি শালিখা উপজেলার দীঘলগ্রামের মৃত রাজেন্দ্রনাথ মন্ডলের পুত্র নরত্তোম মন্ডল। যার গেজেট নং-৩৩৬৩। যিনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহন না করে বা যুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার-প্রচারনা বা যুদ্ধচলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য না করেই অগাধ টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহন করে বনে গেছেন আসল মুক্তিযোদ্ধা। শুধু নরত্তোমই নয় কোটবাগ বগুড়াপাড়ার শরীফ শাহ দেওয়ান। যার গেজেট নং-৩৩৬৪। শুধু এ সকল ব্যক্তি নয় উপজেলাতে এ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় শতাধিক। ওই ব্যক্তি অভিযোগে আরও জানান ‘৭১ যুদ্ধের সময় নরত্তোম এবং তিনি একই সাথে ভারতের কৃষ্ণ নগরের পাশে ভালুকা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন এবং একই সাথে দেশ স্বাধীনের পর ফিরে আসেন। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর নরত্তোম মন্ডল হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টিও হয়েছে।

শালিখায় ২০০১ সালে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিলো ৮২ জন। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১২৫ জনে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশা-পাশি বৃদ্ধি পাওয়া এ সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে।

‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথাও যুদ্ধ না করে মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর হঠাৎ করেই মুক্তিযোদ্ধার সাময়িক সনদপত্র দেখিয়ে অনেকেই বলছে তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ঘোষিত এই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রয়েছে শরীফ শাহ দেওয়ান,নরোত্তম মন্ডল,শুম্ভুনাথ বিশ্বাস,আজিজ মৃধাসহ আরও অনেকে। উপজেলার কোটবাগ গ্রামের বগুড়া পাড়ার শরীফ শাহ দেওয়ান দুটি সনদ বাগিয়ে নিয়েছেন। যা ১৯৯৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আহাদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত সনদপত্রের ক্রমিক নম্বর ১২০৭৮ এবং ২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় প্রদত্ত প্রতিমন্ত্রী ও সচিব স্বাক্ষরিত সনদপত্রের নম্বর ম-১১৪০৪৪, গেজেটের ক্রমিক নং-৩৩৬৪ তাং ১৮ ডিসেম্বর ০৬ সাল। একই গেজেটে নাম রয়েছে দীঘল গ্রামের নরোত্তম মন্ডলের। গেজেটের ক্রমিক নম্বর ৩৩৬৩। দীঘল গ্রামের শম্ভু নাথ বিশ্বাস ও শতখালী গ্রামের আজিজ মৃধাও এ ধরনের সনদ এনে অনেককে দেখালেও ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তারা এ সনদ প্রাপ্তির কথা এখন আর স্বীকার করছেন না। শরীফ-শাহ দেওয়ান ও নরোত্তম মন্ডল মাসিক সম্মানী ভাতাও তুলছেন। তাদের ভাতা প্রাপ্তীতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা জানান, এরা ছাড়াও আরও অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়মিত ভাতা উত্তোলন করছেন।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এ পর্যন্তু প্রকাশিত ৪ তালিকার যেকোন ২ তালিকায় নাম থাকতে হবে এবং গেজেট আকারে নাম প্রকাশিত হতে হবে। এই ৪ তালিকার কোনটিতেই এ সকল মুক্তিযোদ্ধার নাম নেই। মুক্তিযোদ্ধা মুকুল বিশ্বাস ও নারায়ন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন শরীফ শাহ দেওয়ান ও নরোত্তম মন্ডল তাদেরকে বলেছে মাগুরা সদর উপজেলার কমান্ডার জহুর-এ-আলম এ সনদ দুটি এনে দিয়েছেন।

জহুর-এ-আলমের সাথে কথা বললে তিনি জানান শরীফ শাহ দেওয়ান ও নরোত্তমকে আমি চিনি না। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ না নিয়েও এক শ্রেনীর অসাধু ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠিয়ে সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। ওই সব মানুষকে সনদ পেতে সহযোগিতা করছেন উপজেলা - জেলা কমান্ডের একশ্রেনীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা। ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার তিমিরকাঠি গ্রামের মৃত মোজাহার আলী হাওলাদারের পুত্র পুলিশের সাব-ইন্সেপেক্টর মো. মোফাজ্জল হোসেন হাওলাদার ২০১৩ সালের ১১ আগষ্ট শালিখা থানায় যোগদান করেন এবং ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই এলপিআরে যান।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক থানা কমান্ডার মো. আলী আহম্মদ বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করার একটি প্রত্যয়ন পত্র নেন। প্রত্যয়ন পত্রটি নিয়ে তার নিজ জেলা ঝালকাঠির মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাথে যোগাযোগ করে মন্ত্রনালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ বের করেন। এই সনদ দেখিয়ে তিনি চাকুরির মেয়াদ বৃদ্ধির সুবিধা গ্রহন করেন।

এ ব্যাপারে সাব-ইন্সেপেক্টর মো. মোফাজ্জল হোসেন হাওলাদার নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘৭১ সালে অস্ত্র হাতে শালিখায় যুদ্ধ করেছিলাম এবং যুদ্ধ শেষ হলে বরিশালে যেয়ে অস্ত্র জমা দেই। শালিখা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আলী আহম্মদ বিশ্বাস জানান যুদ্ধকালীন কমান্ডার মো. শামছুর রহমান -মোফাজ্জল হোসেনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সুপারিশ পত্র প্রদান করায় আমি প্রত্যয়ন পত্র প্রদান করি। মো. শামছুর রহমান জানান, সাবেক কমান্ডার আলী আহম্মদ বিশ্বাস মোফাজ্জল দারোগাকে আমার কাছে নিয়ে এসে বলেন ইনি শালিখায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাকে মুক্তিযোদ্ধার একটি সুপারিশ পত্র দিতে হবে। মূলত তার পীড়া-পিড়ির কারনেই আমি সুপারিশ পত্র দিতে বাধ্য হই।

তবে দারোগা মোফাজ্জল হোসেনের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন তিনি এ এলাকায় কখনও যুদ্ধ করেননি। শালিখার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. ইদ্রিস হোসেন, মো. মোন্তাজ শিকদার, মো. ছব্দার হোসেন,মো. হাশেম আলী মন্ডলসহ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা জানান নামল্ল্যোখিত সকলেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এ ছাড়া আরও অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তারা ভাতাও উত্তোলন করছেন। তারা আরও বলেন মাগুরায় মুক্তিযোদ্ধার জাল সনদ তৈরী ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। কতিপয় অসাধু মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছে। এ সিন্ডিকেটের সদস্যদের নাম সকলের জানা থাকলেও এদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের কোন উদ্যোগ নেই।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান কমান্ডার মো. আবু বক্কার বিশ্বাস জানান ১৯৯৮-৯৯ সালে কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক ৩ বার যাচাই-বাছাইয়ের পর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিলো ৮২ জন। তাদের নাম মুক্তিবার্তার লাল তালিকায় রয়েছে। গত ১৫ বছরে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১শ২৫ জনে দাড়িয়েছে। উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি থাকলেও তাকে পাশ কাটিয়ে এক শ্রেনীর অসাধু ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাময়িক সনদ পত্র এনে নিজেদেরকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করছেন। তাদের হাতে মন্ত্রনালয়ের সনদপত্র থাকায় তাদের বিরূদ্ধে আমাদের কিছুই করার নেই।

মাগুরা জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. নবুয়ত হোসেন মোল্যা জানান কে কি ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে তা আমার জানা নাই। তবে বর্তমানে জামুকার মাধ্যমে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে শুনেছি। আপনি প্রত্যয়ন না দিলে কি ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি তো সকলকে চিনিনা। থানা কমান্ডাররা নিয়ে আসে তাই আমি প্রত্যয়ন দিই।

(ডিএস/এটিআর/নভেম্বর ০৮, ২০১৪)