শিতাংশু গুহ


শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে লিখলাম, ‘কর্পোরেট বুদ্ধিজীবী’ নিবন্ধ। বিজয় দিবস নিয়ে লিখতে হচ্ছে, ‘বিজিতরা এখন বিজয়ী’। একজন বললেন, দাদা, খালি উল্টাপাল্টা লিখে! বললাম, ভাই, দেশে সবই যখন উল্টাপাল্টা চলছে, সমকালীন লেখা লিখতে হলে আমাকে তো সেই ধারা বজায় রাখতে হবে, নাকি? পাকিস্তানের ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা ২২ লক্ষ পরিবার সৃষ্টি করেছি, এটিও এক ধরণের বিজয় বটে। 

এবারকার বিজয় দিবসের তাৎপর্য একটু অন্যরকম। সামনে নির্বাচন। ঢাকায় একজনের সাথে কথা হলো, জিজ্ঞাসা করলাম, নির্বাচনের খবর কি? বললেন, ভাল, এবার নির্বাচন হবে আওয়ামী লীগ ভার্সেস নৌকা। আমেরিকা কি কয়? আমেরিকা ম্যানেজ হয়ে গেছে, দেখছেন না বিদেশমন্ত্রীর সুর নরম। আশ্বাস দিলেন, নেত্রী থাকতে কোন চিন্তা নাই, সব ঠিকঠাক আছে। বললাম, আমরা তো মাঝেমধ্যে উল্টাপাল্টা শুনি? বললেন, কোন লাভ নাই, দেশ এগিয়ে চলেছে।

শুনে ভাল লাগলো, আসল ঘটনা কি তাই? বলছিলাম, ‘বিজিতরা এখন বিজয়ী’। অর্থাৎ একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখন বিজয়ী। তাঁরা শক্তিশালী। বিজয় দিবসের গৌরব এখন অনেকটাই অনুজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ম্লান হয়ে গেছে, পাকিস্তানী চেতনা বা ধর্মীয় চেতনায় দেশ উজ্জীবিত। মনে প্রশ্ন জাগে, স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি আসলে কখনো ছিলো? জনগণ কি কখনো এটি লালন করেছে? নেতারা কি সেটি ধারণ করেছেন?

উত্তর কঠিন। পাকিস্তান ভেঙ্গে দু’টি পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীনতার পরপর কিছুটা সময় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে লাফালাফি হলেও এরপর ‘সকলি গরল ভেল’। এখন সকল চেতনা ধর্মীয় চেতনার মধ্যে ঢুকে গেছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এখন অভিন্ন চেতনার ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ। তর্কের খাতিরে যদি এখন ‘পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন’ প্রশ্নে ভোটাভুটি হয়, তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পক্ষে পড়বে? সংখ্যাটা আরো একটু বেশি? হতে পারে!

এই মানুষগুলো ‘সাঁধের পাকিস্তান’ ভাঙ্গায় সম্পূর্ণভাবে ভারতকে দায়ী করে। চেতনার ধারক-বাহকরাও অনেকে মনে মনে একই ধারণা পোষণ করেন। ধর্মীয় চেতনায় বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের চেয়েও অগ্রগামী, কারণ সাচ্চা মুসলমান হতে হবে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া পাকিস্তান শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে আমাদের আদর্শ হয়ে গেছে? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়তো কখনো ‘ভাই-ভাইয়ে’ ভুল বোঝাবুঝি হিসাবে আখ্যায়িত হতেও পারে?

বেশি দিনের কথা নয়, দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে একদা ‘নাজাত’ দিবস পালিত হতো। এখন হয়না, আবার যে হবেনা, এ গ্যারান্টি কোথায়? ভারত-পাকিস্তান খেলায় বাংলাদেশীরা পাকিস্তানকে সমর্থন করে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, অবাক হবেন তখন যদি কখনো বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলায় আমরা পাকিস্তানকে সমর্থন করি। খুবই কি অসম্ভব? শক্তিশালী বড়ভাইকে জেতানো তো ছোটভাই’র ঈমানী দায়িত্ব? বড়ভাই’র সাথে জিতলে ভাল, না জিতলে লজ্জ্বার কিছু নেই!

বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু কাগজে, বিজয় দিবস একটি ছুটির দিন্। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ বা বিজয় দিবসের চেতনা বাস্তবায়ন করার কথা ছিলো, তাঁরা কথা রাখেনি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাঁদের হৃদয়ে লেখা ছিলোনা। ‘কাগজে লিখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে; হৃদয়ে লিখো নাম সে নাম রয়ে যাবে…’। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা খুব বেশি মানুষের হৃদয়ে লেখা নেই…. যাঁদের আছে, তাঁদের অবস্থাও বাংলাদেশের হিন্দুদের মত!

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।