মাঈনুল ইসলাম নাসিম : নিরব বিপ্লব নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের মশাল জেলে ‘সরব বিপ্লব’ ঘটিয়ে ইউরোপে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেলেন সফল রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। গ্রীসের স্ট্রবেরি খামারে নিরীহ বাংলাদেশি শ্রমিকদের রক্তচোষা ‘মাস্তুরা’ নামধারী সুপারভাইজার চক্রের শোষণ থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি দূতাবাসতে ঘিরে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ দালাল-সিন্ডিকেট ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে সরাসরি অবদান রাখলেন তিনি কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টে।

লক্ষ লক্ষ ইউরোর পাসপোর্ট বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক দালাল চক্রের চক্ষুশূল হয়েছিলেন তিনি। ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হয়। সততা যেদেশে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা নয়, সেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেষ অবধি তিরষ্কৃত করেছে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদকে। ‘আই ওয়াশ’ তদন্ত কমিটির সাজানো নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে ঢাকায় ফেরার নির্দেশ দেয়া হয় তাঁকে। চলতি সপ্তাহেই এথেন্সকে বিদায় জানাচ্ছেন দূতাবাসকে ‘কলংকমুক্ত’ করার কারিগর গোলাম মোহাম্মদ।

চাকরির মায়া ছেড়ে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল নিরসন করার পথ পরিক্রমায় তাঁকে সাহস যোগায় মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে জীবনের মায়া ছেড়ে যিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে, সেই গোলাম মোহাম্মদ তাঁর সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে কোনদিনই আপোষ করেননি অন্যায়ের সাথে, ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে ছিলেন অবিচল। পূর্ণ সচিব পদমর্যাদার এই পেশাদার কূটনীতিককে এজন্য এর আগেও একাধিকবার বিব্রত হতে হয়েছে শুধুমাত্র অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়ার পরিণতিতে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যাঁর বুকের গভীরে, সেই গোলাম মোহাম্মদ সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দুঃসাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরম দুর্দিনে। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সময়কালে তিনি যখন জর্ডানে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন তখন ঢাকার কঠোর নির্দেশনার বিরুদ্ধাচরণ করে চাকরির মায়া ছেড়ে একান্ত নিজ দায়িত্বে ভিসা ইস্যু করেছিলেন কারাবন্দী শেখ হাসিনার কানাডীয় আইনজীবি ডক্টর পায়াম আখাভানকে। সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে গোলাম মোহাম্মদকে তখন ঢাকায় তলব করে এবং কড়াভাবে শাসিয়ে দেয়।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদই আজ শেখ হাসিনা সরকারের কাছ থেকে তিলে তিলে ‘প্রতিদান’ পেয়ে বিদায় নিচ্ছেন গ্রীস থেকে। রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ আজ এথেন্সে বহাল তবিয়তে না থাকার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর থেকে টানা সাড়ে ৩ বছর দায়িত্বপালনকারী কাউন্সিলর বি এম জামাল হোসেন ঐ সময় দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রদূত আজিজুল হকের উদাসীনতার সুযোগে গ্রীসের আত্মস্বীকৃত দুই দালাল মিজানুর রহমান ও শেখ কামরুল ইসলামকে নিয়ে দূতাবাসের ভেতরে-বাইরে গড়ে তোলেন অবৈধ পাসপোর্ট পিসি ও কেনাবেচার বিশাল অভয়ারণ্য।

২০১৩ সালের গোড়ার দিকে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ এথেন্সে যোগ দেয়ার পর দালালচক্র তাঁকেও অফার দেয় লক্ষ ইউরোর লোভনীয় সিন্ডিকেট বানিজ্যে শরীক হবার। আজীবনের সৎ অফিসারটি সেদিন দালালদের সাথে হাত মেলাননি বলেই গ্রীসের রাজধানীতে ঘটে গেলো এতো তুলকালাম। কয়েক কোটি টাকা কামানো বি এম জামাল চেয়েছিলেন আরো কিছুদিন গ্রীসে থাকতে, কিন্তু গোলাম মোহাম্মদের আপোষহীন নীতির কাছে হার মেনে ঢাকায় ফিরতে বাধ্য হন কাউন্সিলর জামাল। খোদ সেগুনবাগিচা বসেই ‘বিশেষ জেলা’র নাম ভাঙ্গিয়ে তিনি কলকাঠি নাড়তে থাকেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে।

প্রতিশোধের নেশায় মত্ত বি এম জামাল নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন গ্রীসের দালালদের সাথে। আলোর মুখ দেখতে থাকে মাস্টারপ্লানের একের পর এক এপিসোড। প্রথমেই বাজারে ছাড়া হয় মাস্টার এডিটিংয়ের কল্যানে তৈরী একটি ‘হোমমেড’ অডিও ক্লিপ, যার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় রাষ্ট্রদূত সরকারের লোকজনের বিরুদ্ধে গালমন্দ করছেন। এর জবাবদিহি করতে চলতি বছর মে মাসে ঢাকায় যেতে হয় গোলাম মোহাম্মদকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তদন্তে ঐ অডিও টেপটি ‘বানোয়াট’ প্রমাণিত হলে দূতাবাসে ফিরে আসেন রাষ্ট্রদূত। এ যাত্রায় মরণ কামড় দেবার সিদ্ধান্ত নেয় জামাল-মিজান-কামরুল গং।

মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে রাতের অন্ধকারে চুক্তি সম্পাদন হয় এথেন্স আইওএম-এর পার্টটাইম দোভাষী লায়লা এন্টিপাসের সাথে। এথেন্সে কর্পোরেট দেহব্যবসার সাথে জড়িত গ্রীক পাসপোর্টধারী এই বাংলাদেশী নারীকে দিয়েই রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে আনা হয় তথাকথিত যৌন কেলেংকারির অভিযোগ। আগস্টে ঢাকা থেকে আসে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্তদল। আনীত অভিযোগের স্বপক্ষে তাঁরা ন্যূনতম স্বাক্ষ্য-প্রমাণাদি না পেলেও আগে থেকেই ‘রেডিমেইড এন্ড প্রিন্টেড’ তথা সাজানো রিপোর্ট পেশ করে বিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট।

সরকারী নির্দেশ মেনে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ যখন ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিতে চললেন, ঠিক তখনই ‘থলের বেড়াল’ বের হয়ে যায় এথেন্সের ষড়যন্ত্রকারী দালাল সিন্ডিকেটের। রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেয়া সহ যৌন হয়রানির ভূয়া অভিযোগ এবং ‘দোভাষী’ পরিচয়ের আড়ালে দেহব্যবসার সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগে লায়লাকে পার্টটাইম পদ থেকে বহিষ্কার করে আইওএম। অন্যদিকে দালাল সিন্ডিকেটের স্থানীয় নিয়ন্ত্রক মিজানুর রহমান আটকে যায় গ্রীক গোয়েন্দা জালে।

বাংলাদেশী ও পাকিস্তানী ডজন খানেক অবৈধ পাসপোর্ট ও বিপুল পরিমাণ গ্রীক জাল ডকুমেন্ট সহ মিজানকে হাতেনাতে ধরে ফেলে গ্রীক পুলিশ। দু’সপ্তাহের মধ্যেই গ্রীক ইমিগ্রেশন কর্তৃক ‘ব্ল্যাকলিস্টেড’ হয়ে বাংলাদেশে ‘ডিপোর্ট’ হয় বি এম জামালের ‘ডান হাত’ মিজান। প্রসঙ্গত, এই মিজানকে বিগত সময়ে সশরীরে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে সেগুনবাগিচাস্থ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে। বি এম জামালের কক্ষে অবাধ যাতায়াত ছিল তার। আইওএম থেকে লায়লার অপসারণ এবং গ্রীস থেকে দালাল মিজানের ডিপোর্টে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন গ্রীসের হাজার হাজার বাংলাদেশীরা।

মিথ্যা দূরীভূত ও সত্য প্রকাশিত হলেও রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের অপ্রত্যাশিত বিদায়কে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না এথেন্সের বাংলাদেশ কমিউনিটি। তবে এথেন্সে গত পৌনে দুই বছরের দায়িত্বপালনকালীন সময়ে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার সুফল হিসেবে সম্প্রতি ইতালীর মিলানে অনুষ্ঠিত আসেম সামিটে গ্রীক সরকার প্রধান আন্তোনিও সামারাসের সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, তার প্রেক্ষিতে সবাই আশায় বুক বেঁধে আছেন সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়।

(এএস/নভেম্বর ০৯, ২০১৪)