ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ শীতে কাঁপছে। কোথাও কোথাও ২/৩ দিন ধরে সূর্যের দেখা মিলে না।শীতকাল মানেই শীতল হাওয়া বহমান, চারিদিকে কুয়াশা আছন্ন এক পারিবেশ। শীতকালে রাত বড় হয় ও দিন ছোট হয়ে থাকে। বাংলাদেশ, ভারত ও কিছু অঞ্চলে শীতকাল ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে নভেম্বর মাসেই এই শীতের বার্তা আসে আমাদের সকলের মাঝে। শীতকালে তাপমাত্রা কম থাকে ও তাপমাত্রা কমে যায়। আর ঋতুচক্রের হিসাবে পৌষ-মাঘ শীতকাল। শনিবার ১৬ ডিসেম্বর ছিলো পৌষের প্রথম দিন। অতএব, ওইদিন থেকেই কাগজে-কলমে শীতকাল শুরু হয়েছে, যদিও গত প্রায় একমাস যাবৎ শীত শীত ভাব অনুভূত হয়েছে। পঞ্চগড়, মৌলভীবাজার কিংবা চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রিতে নেমে আসায় ওই সব অঞ্চলে শীত আগাম নেমেছে বলা যায়। শীতকালের সূচনা দিনেই দেশের প্রায় সর্বত্র তার আগমনী বার্তা জানান দিয়েছে প্রবলভাবে। ওইদিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৪ এবং কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদফতর দেশকে যে ৪৪টি অঞ্চলে ভাগ করেছে তার মধ্যে ২৫টি অঞ্চলে ওইদিন তাপমাত্রা ১২ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। ফলে বলতেই হবে, দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে শীত নেমে গেছে। সামনে কয়েকদিনের মধ্যে সারাদেশেই হয়তো শীতের দাপট প্রদর্শিত হবে।

আমাদের দেশে শীতকাল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য আরামদায়ক হলেও অধিকাংশ মানুষের জন্য কষ্টের। গৃহহীন, বস্ত্রহীন দরিদ্র মানুষসহ নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য শীত অসহনীয় ও জুলুমস্বরূপ। আগাম শীতে এমনিতেই জনজীবন আড়ষ্ঠ হয়ে পড়েছিল, এখন শীত জেঁকে বসায় তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাবে। এখনো শৈত্যপ্রবাহ বইতে শুরু করেনি। শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিলে জনজীবন চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হবে।আর শীতকালীন রোগের প্রকোপ বেড়েছে। ঠান্ডাজনিত নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। শিশু ও বৃদ্ধরা ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এতে সর্দি, কাশি ও হাঁপানিজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। মজুর পরিবারের মধ্য বয়সী ও বৃদ্ধরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বেশি ভুগছে শিশু। ডায়রিয়ায় গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এরপরই রয়েছে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত সমস্যা, নিউমোনিয়া, জন্ডিস, আমাশয়, চোখের প্রদাহ, জ্বরসহ নানা রোগব্যাধি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বাংলাদেশে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথেই আমাদের মাঝে নানা রোগব্যাধির প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের মৌসুমি জলবায়ুর দেশে প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনের সময়ই দেখা যায় আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন।

আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের সাথে সাথে শিশুসহ সকল বয়সের মানুষের মধ্যে রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এই বাড়তি অসুখের কারণ হলো, আবহাওয়ার এসব পরিবর্তন রোগের নানা উপলক্ষকে করে ত্বরান্বিত যার ফলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ বেড়ে যায়।যেহেতু এই তীব্র শীতে শিশুরা নিউমোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিসহ নানা রোগে খুব সহজেই আক্রান্ত হয়, সেহেতু তাদের এই সময়টাতে শীত উপযোগী কাপড় পরিধান করাতে হবে। গরম কাপড় দিয়ে শিশুদের মাথা ঢেকে রাখলে শরীরের সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকবে। রুম হিটার ব্যবহার করতে পারেন। তবে লম্বা সময় ধরে রুম হিটার ব্যবহার করলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। সম্ভব হলে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঘর থেকে বাইরে বের না করাই উত্তম। শিশুদের অ্যাজমা প্রতিরোধে অবশ্যই ধুলোবালি থেকে দূরে রাখতে হবে। প্রয়োজনে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। দৈনন্দিন ব্যবহার্য জামাকাপড় নিয়মিত সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। শীতবস্ত্র,লেপ-তোশক নিয়মিত রোদে দিতে হবে।

ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হলে অবশ্যই শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। শীত বলে ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে অনেকে এ সময় শিশুদের স্যালাইন খাওয়াতে চান না, যা মোটেই ঠিক নয়। সেই সঙ্গে স্বাভাবিক খাবারও খাওয়াতে হবে। অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের প্রকোপ এই সময় বাড়ে বলে রোগীদের খুব ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বাইরে না যাওয়াই উত্তম। আবাসস্থল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং বিশুদ্ধ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনো কারণে অ্যাজমা পরিস্থিতির অবনতি হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে।

এই শীতে বিশেষ করে বয়স্কদের আর্থ্রাইটিস বা বাতের সমস্যা বেশি বাড়ে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস,এনকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, অস্টিও- আর্থ্রাইটিস রোগীদের শীতের চলাফেরা বা মুভমেন্ট কম হয় বলে ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়। এ জন্য যথাসম্ভব গরম উত্তাপে থাকা, মোজা পরিধান করা, ব্যথার স্থানে হালকা গরম সেক দেয়া, যতটুকু সম্ভব ঘরেই হালকা মুভমেন্ট করা উচিত। তাছাড়া তীব্র ঠাণ্ডায় বাতের কিছু রোগীর হাত-পা নীল হয়ে যেতে পারে(রেনোড ফেনোমেনা) । অনেকের গ্যাংগ্রিনও হয়। এ জন্য চিকিৎসকদের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। এসব রোগীর বারবার পানি ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

তীব্র শীতে বিশেষ করে ভোরের দিকে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। এক্ষেত্রে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ঝুঁকি বেশি। তাই এই শীতে কুয়াশার মধ্যে না হেঁটে, একটু রোদ উঠলে হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করা উচিত। তীব্র শীতের আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হলো হাইপোথার্মিয়া, এতে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে। এই পরিস্থিতিতে কেউ পড়লে রোগীকে দ্রুত গরম আবহাওয়ায় এনে গরম কাপড় পরিধান করে গরম পানি পান করাতে হবে।

তাই শীতের তীব্রতায় এসব শারীরিক সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে আতঙ্কিত না হয়ে প্রয়োজন একটু বাড়তি সতর্কতা। এ সময় সবার উচিত কুসুম কুসুম গরম পানি পান করা। এতে শ্বাসনালিতে মিউকাস তৈরি হয়ে রোগজীবাণু বের হয়ে যায়। এ ছাড়া গোসল ও অন্যান্য কাজে গরম পানি ব্যবহার করাই উত্তম। পরিবারের কেউ ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হলে অন্যদেরও সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে হাঁচি-কাশির সময় মুখে রুমাল ব্যবহার করতে হবে।

এই শীতে কমলা, মাল্টা, বেদানা, মধু, তুলসীপাতা, পালং ও সরিষার শাক, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, রসুন, পেঁয়াজ, আদা, সবুজ শাকসবজি, গ্রিন-টি বেশি করে খাওয়া উচিত। এগুলোর মধ্যে উপস্থিত ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের সজীবতা বজায় রাখে, খাদ্য হজমে সাহায্য করে। শরীরের নিস্তেজভাব কাটায়। টাটকা ফল ও সবজিতে রয়েছে বায়োটিন যা ত্বক ও চুল ভালো রাখে।যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে অভিজ্ঞ চিকিৎসক'র পরামর্শ নিতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, শীত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। তবে আমাদের দেশের দরিদ্র, অসহায়, বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য তা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই আপতিত হয়। তাদের দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা, দুঃখ-যাতনার শেষ থাকে না। তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়, শীত মোকাবিলায়ও সে ধরনের পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। অতীতে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জাতীয় বিপদ-মুসিবতের সময় দেখা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, এনজিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে। বিড়ম্বিত ও অসহায় মানুষকে সাহায্য করেছে। এখন সেটা দেখা যায় না।

শীতের সময় শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ অতীতে অতি সাধারণ ঘটনা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি পর্যায়ে শীতবস্ত্র বিতরণ একেবারেই কমে গেছে, নেই বললেই চলে। প্রশ্ন হলো, বিপন্ন, দায়গ্রস্ত, সাহায্যপ্রার্থী মানুষের প্রতি সাধারণভাবে মানুষের সহানুভূতি, মায়া-মমতা ও কর্তব্যবোধ কি তবে হ্রাস পেয়েছে? মানুষ যদি মানুষের জন্য হয়, তবে একের প্রয়োজনে অন্যের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেই হবে। এটা মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। সরকার তার করণীয় করবে। বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা ও সামর্থ্যবান মানুষ করবে তাদের কর্তব্য। সঙ্গতকারণেই আমরা আশা করবো, সরকার শীতার্ত মানুষের জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি এখনই নেবে। বেসরকারি পর্যায় থেকেও অনুরূপ কর্মসূচি নেয়া হবে।তাই এই শীতের সময় করোনা ও ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচতে মানুষকে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক।