আব্দুস সালাম বাবু : শীত সমাগত, তাঁতের খটখট শব্দে সরব চাদর কম্বলের গ্রাম। ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে এই গ্রামের মানুষগুলো। বগুড়ার আদমদীঘির শাওইলসহ আশেপাশের তাঁত শিল্পীরা উত্তরবঙ্গে আজও ধরে রেখেছে তাঁত শিল্প। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের ছোট একটি গ্রাম শাওইল।

এই গ্রামে অনেক আগে থেকেই তাঁতি শ্রেনীর মানুষের বসবাস। আর তার ফলে শাওইল গ্রামে তখন থেকেই এক ভিন্নধর্মী হাট গড়ে ওঠে। যার মূল শীতের চাদর কম্বল উলের (উলেন) সুতা কেনাবেচা। পর্যায়ক্রমে এই হাটের প্রাচীনতা আর জনপ্রিয়তার জন্য এবং চাদর কম্বল মূলত এই হাটে বেচাকেনা হয় বলে এই হাটের নাম দিয়েছে মানুষ “চাদর কম্বল হাটের গ্রাম”।
ভোর রাত আনুমানিক ৪টা থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। আর হাটের বার হলো রবি ও বুধবার। তাছাড়া এই হাট বসে প্রতিদিনই। এই হাটকে ঘিরে প্রায় ৭৫টি গ্রামে গড়ে উঠেছে তাঁতি পল্লী। তারাই কম্বল কেন্দ্রিক এ শিল্পের এক বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। যখন শাওইলের হাট বসে তখন মনে হয় যেন মেলা বসেছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারী ব্যবসায়ীদের পদচারনায় সব সময় মুখরিত গ্রামের পথঘাট।
এই হাটকে ঘিরে চলে ঢাকা- রাজশাহী সহ সারাদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের চাদর কম্বল আর সুতা কেনার প্রতিযোগিতা। হাটের চারপাশে ঘিরে শত শত ট্রাক, বেবিট্যাক্সি, রিক্সা-ভ্যান এর উপস্থিতি। তাঁতের খটখট শব্দে আর সুতার বুননে মিশে আছে শাওইল।

শীত শুরুর আগেই শাওইলসহ আশেপাশের তাঁতিরা শুরু করে কম্বল তৈরী ও সুতা বোনা। সুতা দিয়ে তৈরী করছে বড় চাদর, কম্বল, বিছানার চাদর থেকে শুরু করে লেডিস চাদর, কম্বল, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালাসহ নানা ধরনের শীত বস্ত্র ও পোষাক। কারও রয়েছে নিজের তাঁত আবার কেউ শ্রম দিচ্ছে অন্যেও তাঁতে।
প্রযুক্তি দাপট তারপরেও এই আদি শিল্প শাওইল গ্রামসহ আশে পাশের গ্রামের মানুষের আকড়ে ধরে আছে। গ্রাম জুড়ে একটানা তাঁতের শব্দে মুখরিত গ্রামের পরিবেশ আর নারী-পুরুষসহ নানা পেশার মানুষের কর্মব্যস্ততা। কেউ সুতা ছাড়াচ্ছে আবার কেউ বা চরকা নিয়ে বসে সুতা নলি বা সূচিতে ওঠাচ্ছে কেউ বা সুতা ববিন করছে। প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় ও ঘরে বসানো পরিপাটি তাঁত যন্ত্র দিন রাত চলছে। প্রতিটি বাড়িতেই কম করে হলেও একটা আর ২টা থেকে ১০টা পর্যন্ত তাঁত রয়েছে। কোনাটা চাকাওয়ালা আবার কোনাটা একেবারেই বাঁশ কাঠ দিয়ে হাতের তৈরী। শাওইল ছাড়াও দত্তবাড়িয়া, মঙ্গলপুর, দেলুঞ্জ সহ আশে পাশের প্রায় ৭৫ গ্রামের চিত্র একই রকম।

শাওইল গ্রামের চারে পাশে তাঁতিদের অধিকাংশ মানুষের মূল পেশায় তাঁত শিল্পকে ঘিরে। আশে পাশের ৭৫ গ্রামে ১০ হাজারেরও বেশি তাঁতি পরিবার আছে আর এ শিল্পকে ঘিরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলে। কেউ বংশ পরম্পরায় আবার কেউবা নতুন করে।

শাওইল হাট ও বাজার কমিটির সভাপতি আব্দুস সাত্তার ও সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন জানান, শাওইল হাটে শুরুতে পাঁচটি দোকান থাকলেও এখন শাওইলের দোকান রয়েছে ছোট বড় মিলে প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০টা দোকান। আর তৈরী হয়েছে নতুন নতুন কারিগর। খুব উন্নত মানের চাদর হওয়ায় এই চাদরের চাহিদা বাংলাদেশে ব্যাপক আর এই চাদরগুলো পৃথিবীর নানা দেশেও যায়। বিভিন্ন গার্মেন্টসের সোয়াটারের সুতা প্রক্রিয়া করে তাঁতে বুনিয়ে তৈরী হয় কম্বল, চাদর সহ আনুষাঙ্গিক পন্য। কোন ধরনের প্রচার ও সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই এখানে গড়ে উঠেছে বিশাল এই কর্মক্ষেত্র। চাদর তৈরীর পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে শীত বস্ত্র তৈরীর মেশিন, সুতা, রং, তাঁতের চরকা, তাঁত মেশিনের সরঞ্জাম ও লাটায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাজারের আশে পাশে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অনেক দোকান। দোকান গুলোতে বেচাকেনায় নিয়োজিত অন্তত আট হাজার শ্রমিক। তারা প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত লট থেকে সুতা বাছাই, ফেটি তৈরী কিংবা সুতা সাজিয়ে রাখে। দিনে ৯০/১০০টাকা মজুরিতে নিয়োজিত এসব কর্মচারীর অধিকাংশ আশেপাশের গ্রামের দরিদ্র মহিলা। শাওইলের চাদর আর কম্বল এর গ্রামকে ঘিরে হাজারো সম্ভাবনা থাকলেও তা সম্ভাবনার খাত হিসাবে কেউ দেখছে না।
তাঁতিদের মাঝে সরকারি সবিধা বাড়াতে পারলে গ্রামটি হতো একটি দৃষ্টান্ত মূলক রপ্তানির ক্ষেত্র। সবচেয়ে অসুবিধা ব্যবসায়ীদের আদমদীঘি থেকে এই বাজারের দুরত্ব প্রায় ১১কিলোমিটার। তাছাড়া শাওইল গ্রামে একটিও ব্যাংক নেই। টাকা লেন দেনের জন্য আসতে হয় আদমদীঘি অথবা সান্তাহারে। সব চেয়ে বড় সমস্যা শাওইল হাটে আসার রাস্তা খারাপ। রাস্তার কারনে ব্যবসায়ীদের খুব সমস্যা হয়। শাওইল হাট এর মত ব্যবসাকেন্দ্রিক স্থানে ব্যাংক নেই তা দুঃখজনক। কারন প্রতিদিনই দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন আর মোটা অংকের অর্থের লেনদেন হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এদেশের তাঁত বস্ত্রের চাহিদা নানা কারনে কমে গেলেও কখনও একেবারেই হারিয়ে যায়নি। তাঁতশিল্পিদের পর্যাপ্ত মুলধনের জোগান, সুস্থভাবে বাজারজাত করনের সুযোগ এবং ঠিকমতো কাচামাল সরবরাহ করলে এখনও আগের মত জনপ্রিয় আর গৌরবময় করে তোলা যায় এদেশের তাঁতশিল্পকে। এদেশের শিল্প সৌন্দর্যেও এক ধারাকে বাচানো যায় ধ্বংসের হাত থেকে। প্রয়োজন কেবল একটু উদ্যোগ। আর তা পেলেই বেচে থাকে এদেশের তাঁতিশিল্প।বেচে যাবেন তাঁত নির্ভর নিরন্ত মানুষ, স্বপ্ন বুনে চলেছেন কেবল আমাদেরই জন্য।

(এএসবি/এটিআর/নভেম্বর ০৯, ২০১৪)