ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


গ্রীষ্মের কাঠফাটা গরমে সারাদিন যেমন আমাদের পিপাসা লাগে, শীতে কিন্তু আমরা খুব একটা পিপাসা অনুভব করি না। ফলে বছরের অন্যান্য সময়ে পানি বা শরবত পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করলেও শীতকালে তার পরিমাণ অনেকটা কমে যায়। এ ছাড়াও, শীতে শরীরকে উষ্ণ রাখার জন্য সারাদিনে অনেকবার চা বা কফি পান করা হয়। 

শীতকালে পানি কম পান করা, প্রচুর চা বা কফি পান করা, কম ব্যায়াম করা বা ফাইবারযুক্ত খাবার কম খাওয়ার কারণেই অন্যান্য সময়ের চেয়ে শীতকালে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেশি দেখা যায়। পেট ঠিকমতো পরিষ্কার হয় না, আর এর ফলে পেটে গ্যাসের সমস্যা লেগেই থাকে। এ ছাড়াও, খাওয়া-দাওয়ায়ও অনীহা বা অরুচির মতো সমস্যা দেখা দেয়।

আর পায়খানা কষা বা শক্ত হওয়াকেই মূলত কোষ্ঠকাঠিন্য বলা হয়। এটি খুব পরিচিত একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। অনেকেরই মাঝে মাঝে পায়খানা খুব শক্ত হয়ে যায়, মলত্যাগের সময় অনেকক্ষণ কসরত করতে হয়। এ ছাড়া পায়খানার পর মনে হয় পেট ঠিকমতো পরিষ্কার হয়নি। কোষ্ঠবদ্ধতা সম্পর্কে একটু বেশি আলোচনা প্রয়োজন। কারণ কোষ্ঠবদ্ধতাই অধিকাংশ রোগের মূল কারণ। গ্রাম্য ছন্দে আমরা বলি, ‘একবার হাগলে দুখী দুবার হাগলে সুখী, আর তিনবার হাগলে রোগী।’ কাজেই দৈনিক একবার পায়খানা হলেও সে সুখী নয়। অথচ এমন বহু মানুষ আছে যাদের একবারও পায়খানা হয় না। কারো দু-তিনদিন অন্তর আবার কারো সাত-আটদিন অন্তর পায়খানা হয়। তবুও তারা বেঁচে থাকে। ডা. হেরিং বলেন, কোষ্ঠকাঠিন্যের ব্যক্তিরা দীর্ঘজীবি হয় যদি তারা এজন্য আত্মহত্যা না করে। এগুলো সবই সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ। দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্য হলে পাইলস বা অর্শ রোগ কিংবা এনাল ফিসার বা গেজ রোগ এর মতো পায়ুপথের রোগ তৈরি হতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ কী কী?

সাধারণত সপ্তাহে যদি তিন বারের কম পায়খানা হয়, তবে সেটাকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলা হয়। এ ছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য হলে যেসব লক্ষণ থাকতে পারে সেগুলো হলো—

* পায়খানা শুকনো, শক্ত চাকার মত হওয়া

* পায়খানার আকৃতি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হওয়া

* পায়খানা করতে কষ্ট হওয়া

* পেট পরিষ্কার হচ্ছে না এমন মনে হওয়া

* পেটে ব্যথা হওয়া, পেট ফাঁপা লাগা, বা বমি বমি ভাব হওয়া

কোষ্ঠকাঠিন্য কেন হয়?

নানাবিধ কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কমন ও গুরুত্বপূর্ণ ৬টি কারণ হলো:-

১.খাবারের তালিকায় যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ না থাকা

২. পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করা

৩.শুয়ে-বসে থাকা ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাব

৪.পায়খানার বেগ আসলে তা চেপে রাখা

৫ .মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা

৬.ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে সৃষ্ট জটিলতা

দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগলে নিচের জটিলতা গুলো দেখা দিতে পারে।

১. অর্শ বা পাইলস হওয়া।

২. এনাল ফিশার বা মলদ্বারে আলসার হওয়া।

৩.রেকটাল প্রোলেপস বা মলদ্বার বাইরে বের হয়ে আসা।

৪. পায়খানা ধরে রাখতে না পারা।

৫. খাদ্যনালীতে প্যাঁচ লাগা।

৬.খাদ্যনালীতে আলসার বা ঘা, এমনকি পারফোরেশন বা ছিদ্র হওয়া ।

> এই কারণগুলো কিভাবে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সৃষ্টি করে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে এগুলো সমাধান করা সহজ হবে।

১. যথেষ্ট ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার না খাওয়া: ফাইবার বা আঁশ হলো এক ধরনের শর্করা। পেট পরিষ্কার হওয়ার জন্য ফাইবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিপাকতন্ত্রের যে জায়গায় পায়খানা তৈরি হয় ও জমা থাকে, সেখানে ফাইবার অনেকটা স্পঞ্জের মত কাজ করে।

পানি শোষণ ও ধারণ করার মাধ্যমে ফাইবার পায়খানায় পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। ফলে পায়খানা নরম ও ভারী হয়, সহজেই শরীর থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার না থাকলে পায়খানা শক্ত হয়ে যায়, ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।

২. পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করা: পানি খাবারের ফাইবারের সাথে মিলে পায়খানাকে ভারী ও নরম করে। এর ফলে পরিপাকতন্ত্রের ভেতর দিয়ে পায়খানা চলাচল সহজ হয়। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

৩. শুয়ে-বসে থাকা ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাব: নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম করলে আমাদের পরিপাকতন্ত্র অর্থাৎ পেটের ভেতরে থাকা নাড়িভুঁড়ি সচল হয়। এতে স্বাভাবিকভাবে পায়খানা বেরিয়ে আসে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের অভাব হলে তাই কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।

৪. পায়খানার বেগ আসলে তা চেপে রাখা: পায়খানা শক্ত হলে অনেকে টয়লেটে যেতে চায় না, কারণ তখন মলত্যাগ করতে কিছুটা কষ্ট হয়। কিন্তু পায়খানার বেগ আসলে তা যদি আটকে রাখা হয়, তাহলে শরীর ক্রমশ সেখান থেকে পানি শুষে নিতে থাকে। পেটের ভেতর পায়খানা জমিয়ে রাখলে সেটা দিন দিন আরও শক্ত হতে থাকে, ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।

৫. মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা: অনেক সময় মানসিক চাপ, কোনো কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা বা বিষণ্ণতায় ভোগার ফলে শরীরের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতির ছন্দপতন হয়, শারীরবৃত্তীয় কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।

পায়খানা কষা কেন হয় তা জেনে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে কোনো প্রকার ঔষধ ছাড়াই সম্পূর্ণ ঘরোয়া উপায়েই এই সমস্যা এড়িয়ে চলা সম্ভব।চলুন জেনে নিই, কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বাঁচতে রোজ কী কী খাবেন-

* খেজুর: খেজুর পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং প্রাকৃতিক আঁশে পূর্ণ একটি ফল। এ ছাড়াও, খেজুর মিষ্টি এবং ঠাণ্ডা প্রকৃতির হয়। যারা কোষ্ঠকাঠিন্য, হাইপার এসিডিটি, জয়েন্টে ব্যথা, চুল পড়া বা লো এনার্জিতে ভুগছেন, তাদের জন্য সেরা খাবার হতে পারে খেজুর। প্রতিদিন সকালে খালিপেটে হালকা গরম পানিতে ২-৩টি ভেজানো খেজুর খান। খেজুরে আছে এমন কিছু পুষ্টিগুণ, যা খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে। কখনো কখনো ডায়রিয়ার জন্যও এটা বেশ উপকারী।

* মেথি বীজ: এক চা চামচ মেথি বীজ সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে খালিপেটে খেতে পারেন। এ ছাড়াও, মেথি বীজ গুড়ো করে নিন। ঘুমানোর আগে এক গ্লাস হালকা গরম পানির সঙ্গে এক চা চামচ মেথির গুড়ো মিশিয়ে খেতে পারেন।

* ঘি: গরুর দুধের ঘি মেটাবলিজম উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি শরীরে হেলদি ফ্যাট বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা ফ্যাট সলিউবল ভিটামিন, যেমন: ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে-কে শোষণের জন্য প্রয়োজন। এক গ্লাস উষ্ণ গরুর দুধের সঙ্গে এক চা চামচ গরুর ঘি দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য দারুণ কাজ করে। তবে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ঘি না খাওয়াই উচিত।

* আমলকী: আমলকী বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রতিদিন সকালে খালিপেটে আমলকী খেলে দারুণ উপকার পাবেন। এক চা চামচ আমলকীর গুড়ো বা ৩টি তাজা আমলকীর রস খেতে পারেন।

* কিশমিশ: কিশমিশে আছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, যা কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতে দারুণ কার্যকর। তবে ভেজানো কিশমিশ খাওয়া ভালো। কারণ, শুকনো খাবার খাওয়ার ফলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে। পানিতে ভিজিয়ে রেখে খেলে এগুলো সহজেই হজম হবে।

এ ছাড়াও, শীতকালে পাওয়া যায় হরেক রকম শাক-সবজি। ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, বেগুন, শিম, টমেটো ও মুলাসহ নানারকমের সবজি। আরও পাওয়া যায় বিভিন্ন রকমের শাক, যেমন: লালশাক, পালংশাক ও মূলা-শাক ইত্যাদি। এসব শাক-সবজিতে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান ছাড়াও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার, যা আমাদের কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে যেমন সাহায্য করে তেমনি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও মলদ্বারের ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে।

হোমিও সমাধান

রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। তাই একজন অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক সঠিকভাবে লক্ষণ নির্বাচন করতে পারলে কোষ্ঠবদ্ধ রোগীকে সঠিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। আবার ইদানিং কিছু হোমিও চিকিৎসক আছে যারা নিজেদের ক্ল্যাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি বলে। ওইসব ডাক্তারদের রোগীরা যখন আমাদের কাছে আসে তখন দেখি অপ-হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দেয় ওইসব ডাক্তার বাবুরা। পেটেন্ট টনিক দিয়ে কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসা দিয়ে থাকে, যেটাকে ডা. হানেমান বলে থাকে শংকর জাতের হোমিওপ্যাথি। তাই যিনি অর্গানন মেনে চিকিৎসা দেয় তার থেকে কোষ্ঠকাঠিন্য চিকিৎসা নিতে হবে।কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকগন প্রাথমিক ভাবে যেসব ঔষধ কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য লক্ষণ সাদৃশ্যে নির্বাচন করে থাকে Bryonia Alb, Nux vomica, Magnesia Mur, Plumbum Met, Opium, Kali Mur, Lycopodium, Graphitis, Calcaria Carb, Siliceaসহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের উপর নির্ভর করে আসতে পারে তাই ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

পরিশেষে বলতে চাই, শীতে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে বাঁধাকপি সেদ্ধ করে সঙ্গে গাজর, শসা, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ, অলিভ অয়েল ও সামান্য লবণ মিশিয়ে খেতে পারেন। এমনকি কিছুটা চিজও মেশানো যেতে পারে। আর প্রতিদিন অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। পানি আপনার হজম প্রক্রিয়াসহ নানা কাজে যেমন সাহায্য করে, তেমনি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও সাহায্য করে। দিনে ২ থেকে ৩ কাপের বেশি চা বা কফি না খাওয়াই ভালো। আর শীতে জুবুথুবু হয়ে বসে না থেকে ঘোরাঘুরি করুন। খেয়েই ঘুমোতে যাবেন না। হাঁটাহাঁটি করুন।

লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক।