রহিম আব্দুর রহিম


চুয়ান্ন বছর বয়ষ্ক আলমগীর হোসেন ঢাকায় রিকশা চালান। দুই সন্তানের জনক আলমগীরের বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে ঢাকা কলেজে পড়ে।প্রতিদিন সকালে পত্রিকা পড়ে রিকশা নিয়ে বের হয়। শরীয়তপুরের এই ভদ্র লোকের যাত্রী হয়েছিলাম ২৫ ডিসেম্বর।রিকশা প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সম্মুখ রাস্তা হয়ে পুলিশ যেতে দিচ্ছে না, ফিরিয়ে দেওয়া হলো আমাদের। পুলিশের প্রতি আলমগীরের অনুযোগ, 'ফাঁকা সড়ক এরপর পুলিশ তার ক্ষমতা দেখাচ্ছে।' তাকে বললাম, আমি সাংবাদিক। চলেন পরিচয় দিলে ছাড়ে কি না? দেখি। ছাড় পেলাম। এবার আলমগীর ২৮ অক্টোবরের ঘটনা শোনালেন, বললেন, "স্যার প্রধান বিচারপতির বাড়িতে আক্রমন করছে। আহ্ হা- হা একজন পুলিশকে পিটিয়ে মারছে! তার সন্তানের কি হবে? কয়েক দিন আগে ট্রেনে আগুন দিয়েছে, একজন মা তাঁর সন্তানকে বুঁকে জড়িয়ে মারা গেছে।জানতে চাইলাম এইগুলো কারা করছে? তাঁর জবাব, "আমরা তো দেখি নাই স্যার,আল্লাহ জানে। যারা এগুলো করছে, আল্লাহ তাদের বিচার করবে।"
গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম, ভাড়া মিটিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, এবার ভোট দিতে গ্রামে যাবেন তো? ' "যাবো না মানে, নদী ভাঙ্গা এলাকার মানুষ, অভাবের সংসার কোন বারই ভোটের সময়ই বাড়ি যেতে পারি না, ভোটও দিতে পারি না, এবার আমরা শরীয়তপুরের যারা ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করি, রিকশা চালাই সবাই মিলে মিশে বাড়ি যাবার জন্য একত্রিত হচ্ছি। এবার ভোটও সুষ্ঠু হবে।"

গত ১৮, ১৯,২০ ডিসেম্বর জামালপুর সদর নির্বাচনী এলাকার গ্রাম, শহর, উপশহর ঘুরে দেখেছি, নির্বাচন জমে উঠেছে। তবে ভোটারদের কথা একটাই, 'ভোট কি দিতে পারবো? দিলে তো ফলাফল উল্টে যাবে না?" ২১ ডিসেম্বর পরিদর্শন করেছি জামালপুরের নিভৃত পল্লীতে ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত গান্ধী আশ্রম। যাবার পথে কথা হয়েছে মাদারগঞ্জ -মেলান্দহ নির্বাচনী এলাকার জনৈক ভোটারের সাথে। যিনি পেশায় জেলে।ভোট বিষয়ক কথা উঠলে তিনি জানান, 'এখন আর ভোটাদের আদর নাই।' অন্যদিকে সরিষাবাড়ি নির্বাচনী এলাকায় কোন প্রার্থীই সম্ভবত ভোটারদের সাথে তেমন কোন জনসংযোগ করেনি। তবে সকল প্রার্থীই শক্তিশালী কেন্দ্র কমিটি করেছে বলে অনেকেই জানিয়েছেন।ময়মনসিংহের মুক্তাগাছাও ভোটের আমেজ পরিলক্ষিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের নির্দেশনা, প্রার্থীরা যেনো ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যান।তা কতটা হচ্ছে এটাই বিশ্লেষণের বিষয়।

অপরদিকে বিএনপি অব্যাহত আন্দোলনকে ঘিরে গত ২৮ অক্টোবর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই মাসের ব্যবধানে দুবৃত্তদের দেওয়া আগুনে ৪০২টি যানবাহন পুড়েছে।ভাংচুর হয়েছে ৩৩৪টি যানবাহন। সহিংসতার ঘটনায় ৯০২ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে ভোটাদের উপস্থিতি, বিএনপি'র নিরুৎসাহের যে টানাটানি চলছে তাতে সাধারণ ভোটারদের একাংশের বিশ্বাস "এবার নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, ভোটাররা ভোট প্রয়োগ করতে পারবেন। সাধারণের এই বিশ্বাসে যদি কেউ আঘাতহানে তবে যা হবার তাই হবে। ভোটের মাঠে সংঘাত -সহিংসতা থাকবেই। তবে তা সামাল দেবার মত সৎ সাহসও থাকতে হবে। যে পুলিশ, র‌্যাব দেশের জঙ্গিবাহিনী নিমূর্লে সফল, তারা কেনো অস্ত্রের মহড়া ঠেকাতে পারবে না। ইসি কেনো পারবে না সুষ্ঠু নির্বাচন করতে? সাধারণ ভোটারদের বিশ্বাস স্থায়ী করণ ও আশংকা দূরীকরণে সরকার যন্ত্রের কঠোর অবস্থান যেমন জরুরী হয়ে পড়েছে; তেমনি ক্ষমতাসীন দলের দায়বদ্ধতা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সর্তক থাকতে হবে, নির্বাচনের আগের দিন, নির্বাচনের দিন ও তার পরের দিন দুবৃত্তরা কোন নাশকতা বিশৃঙ্খলা করতে যেনো না পারে। অপরাধীরা গ্রেফতার হোক, কোন নিরপরাধকে যেনো কষ্ট না দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, "অপরাধীর আর্তচিৎকারের চেয়ে নিরপরাধীর দীর্ঘশ্বাস ভারী।" রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জানা থাকা দরকার, রাজনীতি মানুষের জন্য, ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য নয়।" সেই মানুষদের বৃহৎ একটা অংশ ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ নির্বাচন দেখার অপেক্ষায়।

লেখক : কলামিস্ট গবেষক ও শিশু সাহিত্যিক।