ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শীতে সাধারণত শরীর ঘামে না। তাই অনেকে মনে করেন, নিয়মিত কাপড় না ধুলেও চলে। বিশেষ করে গরম কাপড়গুলো মোটা বা উলের হওয়ায় বাবা-মা এসব ধুতে অলসতা করেন। শিশুকে সুস্থ রাখতে অবশ্যই সময়মতো কাপড়চোপড় ধুয়ে পরাতে হবে। আবহাওয়া ও ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। এ সময় শিশুদের নানা রকম রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শীতকালে এটি বেশি ঘটে। তাই শীতের শুরুতেই শিশুদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি।

শিশুদের ত্বকের শীতকালীন সমস্যা কি কি

শীতের শুষ্ক এবং শীতল হাওয়া খুব সামান্যই আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে। শিশুর ত্বক বয়স্কদের তুলনায় বেশি স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল। ফলে খুব সহজেই ত্বক বেশি মাত্রায় আর্দ্রতা হারাতে থাকে। এর মানে শিশুর ত্বক অল্প সময়েই শুষ্ক হয়ে যায়।

সাধারণত শিশুর ত্বকে শীতকালে এসব সমস্যা হতে দেখা যায়। যেমন:

১) ঠোট ফাটা: শিশুদের মুখ দিয়ে লালা ঝরা একটি প্রচলিত সমস্যা। যখন বাচ্চার ঠোট বা আশেপাশের জায়গা লালা দিয়ে ভেজা থাকে সর্বদা, তখন ওই অঞ্চলের ত্বক সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে। আর এই থেকেই ত্বকের শুষ্কতা বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় ঠোটের চামড়া উঠতে দেখা যায়।

২) লালচে শুষ্ক গাল: অনেক সময় শিশুর গাল সহজেই লালচে শুষ্ক হতে দেখা যায়। বাইরের শীতল হাওয়া এর জন্য দায়ী।

৩) শুষ্ক ত্বকে চুলকানি: শুষ্ক শীতল বাতাস সহজেই বাচ্চার ত্বককে শুষ্ক করে তোলে। বাচ্চার ত্বকে জন্ম নেয় র‍্যাশ। আর যদি আগে থেকেই বাচ্চার একজিমার সমস্যা থাকে, তাহলে বাচ্চার ত্বকে চুলকানির মাত্রা হঠাৎ অনেক বাড়তে পারে।


শীতকালে শিশুর যত্ন নেয়ার কিছু সাধারণ কৌশলের কথা। চলুন জেনে নেয়া যাক-

নিয়মিত গোসল

অনেক বাবা-মা মনে করেন, শীতকালে শিশুকে প্রতিদিন গোসল করানো ক্ষতিকর! কিন্তু এটি ভুল ধারণা। গোসল না করার ফলে শিশুর শরীর আর চুলে ধুলা লেগে যায়, এটি খুবই অস্বাস্থ্যকর। ঠান্ডা পানি না হলেও কুসুম গরম পানিতে শিশুকে প্রতিদিন গোসল করানো উচিত। গোসলের ক্ষেত্রে বেবি সোপ ব্যবহার করা উপকারী। এতে শিশুর স্বাস্থ্যের ভাবনা যেমন দূর হবে পাশাপাশি শিশুও থাকবে চনমনে।

হাত ধোয়া

শীতকালে বেশির ভাগ বাবা-মা শিশুকে পানি ধরতে দিতে চান না। ভাবেন এতে হয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে। এই ধারণাটি ঠিক নয়। শিশুকে সুস্থ রাখতে হলে অন্যান্য সময়ের মতোই নিয়মিত হাত ধোয়ানো জরুরি। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় এটি অত্যাবশ্যক। কারণ শিশুরা সারা দিন নানা রোগ-জীবাণুবাহী বস্তু হাত দিয়ে ধরে, যা তাদের অসুস্থতার অন্যতম কারণ।

গরম কাপড়ের পরিচ্ছন্নতা

শীতে সাধারণত শরীর ঘামে না। তাই অনেকে মনে করেন নিয়মিত কাপড় না ধুলেও চলে। বিশেষ করে গরম কাপড়গুলো মোটা বা উলের হওয়ায় বাবা-মা এসব ধুতে অলসতা করেন। শিশুকে সুস্থ রাখতে অবশ্যই সময়মতো কাপড়চোপড় ধুয়ে পরাতে হবে।

ঘরের আবহাওয়া

শীতে ঠান্ডায় ভয়ে অনেকেই ঘরের দরজা-জানালা খুলতে চান না। মনে রাখতে হবে, বদ্ধ ঘরে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে না বলে জীবাণু সংক্রমণ বেড়ে যায়। ঘর স্বাস্থ্যসম্মত রাখার অন্যতম শর্ত হলো- ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রাখা। দিনের বেলায় অন্তত কিছু সময়ের জন্য ঘরের সব দরজা-জানালা খুলে রাখা উচিত।

খাবার ও পানীয়

শীতকালে শিশুদের খাওয়ানোর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব ঠান্ডা খাবার এড়িয়ে চলুন। যদি খাবার ফ্রিজে থাকে তাহলে অবশ্যই পরিবেশনের আগে গরম করে নিন। তবে ফ্রিজের খাবার খাওয়ানোর চেয়ে সব সময় টাটকা খাবার খাওয়াতেই চেষ্টা করা উচিত। এ ছাড়া দিনে অন্তত একবার গরম দুধ, স্যুপ বা হেলদি ড্রিংক খাওয়াতে পারলে শিশুর জন্য ভালো।

খেলাধুলা

অসুস্থতার দোহাই দিয়ে অনেকেই শিশুদের খেলতে দিতে চান না। এটা মোটেই উচিত নয়। শীতের সময় খেলাধুলা কমিয়ে দিলে বা একদমই না করলে শরীরের ভেতর যে কোষগুলো রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সেগুলো দুর্বল হতে থাকে। তাই এ সময় পর্যাপ্ত খেলাধুলা করা জরুরি।

ঘুম

পর্যাপ্ত ঘুম ছোট-বড় সবার জন্যই অত্যন্ত জরুরি। শিশুদের সুস্থতায় ঠিকমতো ঘুমের বিকল্প নেই। খেয়াল রাখতে হবে শিশুরা নির্দিষ্ট পরিমাণে ঘুমাচ্ছে কি না। কারণ ভালো ঘুেম শরীরে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমায়।

পানি পান

শীতকালে পানির পিপাসা কম লাগে। তাই শিশুদেরও পানি পানে বেশ অবহেলা দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, এ সময়েও শিশুর শরীরে পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন আছে। তাই সময়মতো শিশুকে পানি পান করাতে হবে।

শীতে শিশুর খাদ্য

শীতকালে শিশুদের খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। ফলে শরীর খারাপ হয়। এ সময় শিশুর খাবারে উপস্থিত থাকা চাই পর্যাপ্ত ভিটামিন সি। এক্ষেত্রে মাল্টা, লেবু ও কমলার মতো সাইট্রাসজাতীয় ফল বেছে নিতে পারেন। যেসব বাচ্চা চিবিয়ে খেতে পারে না, তাদের ডিমের কুসুম, সবজির স্যুপ, খিচুড়ি, ফলের রস খাওয়ান। মোটকথা, শীতের এ সময়ে শিশুকে তার বয়স ও চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়াতে হবে।

হোমিও সমাধান

হোমিওপ্যাথিতে রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসককে ডা. হ্যানিমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে শিশুদের যেকোনো জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা- ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিত্তিক, লক্ষণ সমষ্টিনির্ভর ও ধাতুগতভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে স্থায়ী চিকিৎসা দেয়া সম্ভবহোমিওপ্যাথি হলো বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি।

সামগ্রিক উপসর্গের ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচনের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করা হয়। এটিই একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে রোগীর কষ্টের সমস্ত উপসর্গগুলো দূর করে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের অবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়।

পরিশেষে বলতে চাই, প্রতি বছর মৌসুমের বদলে শীত আসবেই। শীতকালে শিশুদের শারীরিক পরিবর্তনগুলো খুব দ্রুত হয়ে থাকে। ফলে অনেক সময় আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। অথচ এসব পরিবর্তনের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে বড় কোনো রোগের বীজ। বাচ্চাদের এ অসুস্থতা ভালোভাবে খেয়াল করলে বাইরে থেকেই বোঝা যায়। যেমন নাক, কান, পায়ের পাতা, আঙুল ফ্যাকাশে হয়ে গেলে বুঝতে হবে শিশু ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় ভুগছে। বাচ্চার কথা বলতে অসুবিধা হলে কিংবা কাঁপতে থাকলে বুঝতে হবে হাইপোথারমিয়া। যেটি শীতকালে শিশুদের ক্ষেত্রে পরিচিত সমস্যা। রোগের উপসর্গ বুঝে মা-বাবাকে শিশুর জন্য দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।নিয়মগুলো মেনে চললেই শীতে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।