চৌধুরী আবদুল হান্নান


যে কাজটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বপ্রণোদিত হয়ে করার কথা কিন্ত তা শুরু করার জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষা কেন ? আইন আছে, ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না; নির্বাচন করতে হলে খেলাপি ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু ঋণখেলাপিদের থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ের সর্বোচ্চ তৎপরতা প্রত্যাশিত ছিল কিন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রধানদের মধ্যে এমন আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। এমন কি ব্যাংক ব্যবস্থার খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্হা বাংলাদেশ ব্যাংকও যেন ক্লান্ত, ঝিমিয়ে পড়া একটি প্রতিষ্ঠান।

যখন অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত ২৮ নভেম্বর এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দিলো স্বাধীন সংস্থাটি কেবল তখনই একটু নড়েচড়ে বসলো। অর্থমন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে সংসদ নির্বাচনে প্রর্থীদের কেউ ঋণখেলাপি কিনা নির্বাচন কমিশনে তা জানানোর জন্য।

অতপর এ বিষয়ে সকল ব্যাংককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ৩০ নভেম্বর একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

যেভাবে খেলাপি ঋণগ্রহীতারা পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাকে গ্রাস করে ফেলেছে তার গুরুত্ব ও ভয়াবহতা বিবেচনা করে কেন বাংলাদেশ ব্যাংক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষা না করে আরও কয়েক মাস পূর্ব থেকে এ উদ্যোগ নেয়নি, এমন প্রশ্ন থেকেই যায়। এমনিতেই দুষ্টচক্রকে সহজে আটকানো যায় না; অথচ যখন সুযোগ আসে আমরা তা সঠিকভাবে এবং দ্রুততার সাথে কাজে লাগাই না।

একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। তার প্রধান কারণ বাহির থেকে বিভিন্ন মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপ। এ অজুহাতে অতি সহজ দৈনন্দিন কাজ করার প্রতি তাদের আগ্রহ হারানো শুভ লক্ষণ নয়। স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে যত বাঁধাই থাকুক না কেন, সদিচ্ছা থাকলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সহজেই করা যায়।

বিগত দিনে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঋণখেলাপিদের দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্য করা গেছে, উল্লেখযোগ্য পরিমান খেলাপি ঋণ আদায়েরও রেকর্ড রয়েছে। ঋণ আদায়ের এক মোক্ষম সুযোগ বিপুল উৎসাহে কাজে লাগানোর তৎপরতা ব্যাংকারদের মধ্যে দেখা যেত। আইনের চাপে এবং ব্যাংকারদের আগ্রহে ঋণ নিয়মিত করার জন্য ঋণখেলাপিরা ব্যাংকমুখী হতে বাধ্য হতেন। এবারের নির্বাচনেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক না হলেও কিছু কিছু ঋণখেলাপি প্রার্থী চাপে পড়ে তাদের খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ব্যাংকে আসেননি, তা নয়।

বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ খেলাপের দায়ে নির্বাচনে ১১৮ প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে (সমকাল, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৩)। তবে এদের মধ্যে কতজন ঋণ নিয়মিত করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন তা জানা যায় না। এদিকে নেয়াখালী অঞ্চলের একজন প্রার্থী খেলাপি ঋণ পরিশোধের জন্য এক বেপরোয়া কান্ড করেছেন, মসজিদের ফান্ড থেকে ৩ কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছেন। তিনি ওই মসজিদের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন; চাপে আর লোভে মানুষ কত কিছুই না করে! একদিকে ঋণ পরিশোধের চাপ, অন্যদিকে এমপি হওয়ার লোভ।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সমগ্র ব্যাংকিং খাত থেকে কি পরিমান খেলাপি ঋণ আদায় হলো তা জানা গেল না। বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয়ভাবে একটি মনিটরিং সেল গঠন করে এ তথ্যটি প্রকাশ করলে জনসাধারণের কাছে একটি বার্তা যেত যে কর্তৃপক্ষ অলস বসে নেই।

খেলাপি ঋণ বর্তমানে এমন নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে যে, ব্যাংক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার ভাবনা এখন মরীচিকা এবং এ খাতটি প্রকৃতই দুষ্টদের অভয়ারণ্য।

অন্যদিকে সিপিডি থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশের ব্যাংকিং খাত বিষয়ে একটি ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে এসেছে, গত ১৫ বছরে ৯২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তথ্যটি জনসমক্ষে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন অর্থ লুটের এ চিত্র আংশিক, পূর্ণ চিত্র নয়।

প্রতিষ্ঠিত অভিযোগ আছে, ব্যাংকগুলো থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না, প্রকৃত তথ্য গোপন করে তারা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা সাময়িক ভালো দেখাতে চায়।

অন্যদিকে লুটপাটকৃত ওই টাকার কত অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে আর কত অংশ দেশের অর্থবাজার এবং পুঁজিবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে চলেছে তা জানার কোনো পথ নেই, কোনো পরিসংখ্যানও নেই।

“দেড় ডজন ঋণখেলাপি পালিয়েছেন কানাডায়” শিরোনামে গত ২৪ ডিসেম্বর কয়েকটি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। তারা চট্টগ্রাম অঞ্চলের শীর্ষ ঋণখেলাপি কয়েক হাজার কেটি টাকা নিয়ে সপরিবারে বিদেশে পাড়ি জনিয়েছেন। তারা এখন পগার পার, কে ধরবে তাদের ? তারা কিন্ত একদিনে পালিয়ে যায়নি, গোছগাছ করতে, গুছিয়ে নিতেও নিশ্চয়ই কয়েক বছর সময় নিয়েছিল। তারা ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়েছে।

ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে পরিবার নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্য দেশে “সেকেন্ড হোম” তৈরির এ চিত্র দেশের সামগ্রিক চিত্র নয়, সারা দেশের চিত্র অনেক ভয়াবহ।

কে খুঁজে বের করবে দেশদ্রোহী এসকল ঋণখেলাপি অর্থ পাচারকারীদের ? যারা খোঁজ করবে, তাদেরই কোনো খোঁজ নেই।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনার দায় মূলত নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর বর্তায়। যে প্রতিষ্ঠানটি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতেই পারে না, সে অন্যকে পথ দেখাতেও পারে না। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, এখন তা ই ভাবতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।