আরিফুন নেছা সুখী : ‘মা’ একটি অক্ষর, একটি বর্ণ, একটি শব্দ। যদি বলি মা মানে একটি পৃথিবী, একটি বিশ্ব, একটি জগত—ভুল হবে না এতটুকু। কেননা ঠিকই তো, জন্মের আগে একটি শিশুর বসবাস, বেড়ে ওঠা সে তো মায়ের জঠরেই। তাহলে মা কেন পৃথিবী নয়, বিশ্ব নয়, নয় জগত। মা এমনই একটি শব্দ যার কোনো বিশেষণ লাগে না। যাকে বলে একাই একশ’। প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় বিশ্ব মা দিবস।

বছরের পুরোটা সময় জুড়ে অপেক্ষায় থাকি কবে আসবে মা দিবস। ডায়েরির পাতাজুড়ে লিখি—মা তোমাকে মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে, ভীষণ মনে পড়ে। মা আমার স্বর্গলোকের বাসিন্দা। তাই বলে কি আমার বা আমার মতো মা-হারাদের মা দিবস থাকবে না? অবশ্যই না। মা’র জন্য হৃদয় খুলে দোয়া করব। আর দু’চোখ বন্ধ করে স্বপ্নে মা’র কোলে মাথা রেখে হারিয়ে যাব স্বপ্নলোকে।
মা’র জন্য একটা সুদৃশ্য মগ কিনেছে হলিক্রস কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী বিলকিছ। তার সঙ্গে কথা হলে সে জানায়, তার বাবা নেই, মা-ই তার পৃথিবী। সে মাকে খুব ভালোবাসে। মা মোগলাই খেতে পছন্দ করেন তাই মার জন্য মোগলাই কিনবে। আর একটা মগটা দেবে, মা খুব খুশি হবেন।
আঁখি সিটি কলেজের বিবিএ’র ছাত্রী। সে মার জন্য শাড়ি কিনেছে। আঁখি মনে করে, মা দিবস কয়েক দিনব্যাপী হওয়া উচিত। আর বিশ্বে প্রায় সব দেশেই রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই বিশেষ দিনগুলো রোববার নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের জন্য একটু সমস্যা, কেননা রোববার অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ খোলা থাকে। ইচ্ছে থাকলেও মাকে সময় দেয়া যায় না। আমার ভাইয়া যেমন আসতে পারেনি। ও মানিকগঞ্জে চাকরি করে। তাই মা দিবস শুক্রবার হওয়া উচিত। আমাদেরটা আমাদের মতো হবে।
রুবি রহমান—তিনি একজন মা। আবার একজন তার মা, এই অনুভূতিটা কেমন তার কাছে। তিনি জানালেন, আমার মেয়ে লালিত্য এখনও অনেক ছোট। মা বলতে পারে মাত্র। এ বছর জুলাইয়ে দুইয়ে পা দেবে। তাই আমি এখনও মা দিবসের শুভেচ্ছা পাইনি। পেতে এখনও বছর তিনেক সময় লাগবে। ও কচি হাতে আমাকে যা দেবে, আমার অনেক ভালো লাগবে। আমার মা গ্রামে থাকেন। তার কাছে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু হয়ে ওঠে না। মোবাইলে মাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। আর মার জন্য শাড়ি কিনে পাঠিয়েছি। আমার শাশুড়ি মাকেও একটা শাড়ি কিনে দিয়েছি।
মা দিবস মানে অনেকে মনে করেন একদিন মা দিবস পালন করা। একটু কেমন আদেখলেপনা। মা দিবস। এটা আবার কী কথা। কিন্তু সত্যি কি মা দিবস থাকা উচিত নয়।

আসমা ইডেন কলেজের ভূগোলের ছাত্রী। তিনি জানান, অবশ্যই মা দিবস থাকা উচিত। অন্তত একটি দিন মা’র জন্য বরাদ্দ। মাকে নিয়ে দুটো কথা বলা। মা’র জন্য কিছু কেনা। এই দিনটা একটা উত্সব। মা দিবসে ফ্যাশন হাউসগুলো বিশেষ আয়োজন করে। মাদের নিয়ে বিভিন্ন গিফট কার্ড, মগ তৈরি করা হয়। যা সত্যি অসাধারণ। মা দিবস যুগ যুগ ধরে থাকবে এবং এর প্রসার দিন দিন বাড়বে।
বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক প্রকল্পের ছাত্র গাজী মুনছুর আজিজ মা দিবসের কথা উঠতেই বললেন, আমার মা তেমন শিক্ষিত নন। ঘড়ির ব্যবহার জানেন না। তবুও তিনি আমার পরীক্ষার সময় প্রতিদিন ভোরবেলা ঠিক পাঁচটার সময় ডেকে দিতেন, এক মিনিটও এদিক-ওদিক হতো না। চা বানিয়ে দিতেন, মুড়ি মাখিয়ে দিতেন। আমার সঙ্গে তিনিও জেগে থাকতেন। আবার আমার পরীক্ষার দিনে মা রোজা রাখতেন। এই আমার মা। আমি প্রতি বছর মা দিবসে মাকে নিজ হাতে তৈরি করা উপহার দিই। সঙ্গে শাড়ি কিনে দিই। মা দিবসে সবারই উচিৎ মা’র কাছে থাকার চেষ্টা করা। তাই এই দিনটা সরকারি ছুটি ঘোষণা করলে আরও তাত্পর্যপূর্ণ হয়ে উঠত।
মাকে কখনও বলা হয়নি—মা তোমাকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। মা দিবস সেই সুযোগটা তৈরি করে দেয়—বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিহাব। তার মতে মাকে মনে করা, মাকে উপলব্ধি করা, মাকে শুভেচ্ছা জানানো, মাকে সরি বলা—সব মিলিয়ে শুধুই মা। মনটা আনমনে গেয়ে ওঠে—মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল/ সকলই ফুরায়ে যায় মা...। সবকিছু শেষ হয়ে যায়, কিন্তু মায়ের ভালোবাসা অনিঃশেষ, নিঃস্বার্থ। তাই তো একজন প্রতিবন্ধী শিশুকেও কতটা মমতায় আপন করে নেন মা। গানের ভাষায়—ল্যাংড়া আঁতুড় কানা খোঁড়া হলে পরে ছেলে/ অঞ্চলে ধুলা মুছাইয়া টান দিয়া নেয় কোলে...। মা যেন একটা সমুদ্র। তাকে দেখে শেষ হয় না, চোখ জুড়িয়ে যায় মায়ের মুখের দিকে চেয়ে—মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে...। কিন্তু বাস্তবতার নির্মম পরিহাসে আমরা হয়ে ওঠি অতি নির্মম। ব্যস্ততার অজুহাতে ভুলে যাই মাকে। কেমন আছো জিজ্ঞেস করা হয় না। স্বামী-স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখসঙ্গে মেতে থাকি। ভুলে যাই মা আমার খোলা আকাশে চেয়ে তারা গোনে, রাত যায় দিন যায়, ছেলে-মেয়ে তার কাছে আসে না।
কুমার বিশ্বজিৎ গেয়েছেন—তুমি কত লিটার দুধ করেছ পান/ মা জননীর/ এক বাটি দুধ হাতে নিয়ে/মা জননীর কাছে গিয়ে/কখনও কি বলিয়াছ/মাগো আপনি খান...। সত্যি বলা হয়নি, বা বলা হয়ে ওঠে না। মা তো আমারই, তাকে আবার নতুন করে আয়োজন করে বলতে হবে, ‘মা আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ কিন্তু বললে ক্ষতি কিছু তো নেই। মায়ের কোলে মাথা রাখলে মা যদি আপনার কপালে চুমু দেন, আপনি কেন মায়ের কপালে দেবেন না।
হিমশীতল ঠাণ্ডা শরীরটাতে হাত দিয়েই চমকে উঠে বলি— মার না জ্বর, তাই থার্মোমিটার পাঠালাম, মার শরীরটা এত ঠাণ্ডা কেন। এরপর আর কিছু বলতে পারিনি। এক টুকরো পাথরের মতো বসে থেকেছি মায়ের শরীরের পাশে, মা আমার কোনো কথা বলেননি।
ঠিক মাসখানেক আগে যেদিন মা ঢাকায় গেলেন, সেদিনও কিছু বলে যাননি আমাকে। আমি ছিলাম হোস্টেলে, চলছিল ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। কিছুই জানানো হয়নি আমাকে। বিকালবেলা হঠাত্ করে কান্নায় ভেঙে পড়ি আমি। বারবার বলতে থাকি, মা’র কাছে যাব। সন্ধ্যায় আব্বা আসেন আমাকে দেখতে। আব্বাকে জড়িয়ে ধরেও একইভাবে কাঁদতে থাকি। আব্বা তো পুরো অবাক, কী এমন হলো মেয়ের। আমি বারবার বলতে থাকি, আমি মা’র কাছে যাব। তখন আব্বা বলেন, তোমার মাকে তো ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আমার আর মা’র সঙ্গে দেখা হবে না। আব্বা বোঝান, তোমার মা’র চিকিত্সা হয়ে গেলেই সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু মন বলছিল, আমার আর মা’র সঙ্গে দেখা হবে না। সত্যি সত্যি আর দেখা হয়নি। এই অসাড় দেহটার সঙ্গে দেখা হওয়াটাকে কি দেখা হওয়া বলে! মা একবার মোবাইলে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। অভিমানী আমি কথা বলিনি তার সঙ্গে। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরলে গলা জড়িয়ে ধরে সব কথা বলব। কিন্তু তা আর হলো কই? তুমি এলে ওপারের বাসিন্দা হয়ে। তোমার আর আমার মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। মাগো, আজও বড্ড জানতে ইচ্ছে করে—কী বলতে চেয়েছিলে তুমি? জানি বলতে— লক্ষ্মী হয়ে থাকিস মা আমার। ভাইবোনের কথা শুনিস আর কারও ওপর রাগ করিস না। বলো মা, তুমি কি ঠিক এই কথাগুলোই বলতে না! জানা কথা, তবুও বারবার আফসোস হয়—কেন আমি তোমার কথাগুলো শুনলাম না। এভাবে বলছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অনার্সের ছাত্রী বেবী।
আমরা অনেকেই মা’র কথা শুনি না। মাকে কষ্ট দিই। কিন্তু মা ছাড়া যে আমাদের জন্মই হতো না। সে কথা ভুলে যাই অবলীলায়। ব্যস্ত হয়ে উঠি নিজের মতো। একটু বড় হলেই মাকে বলি, তুমি কী বোঝ। সত্যি কি মা কিছুই বোঝেন না। কিন্তু আমরা যখন ছোট্ট ছিলাম, কথা বলতে-হাঁটতে পারতাম না, তখন মা বুঝতেন অনেক কিছু। একজন দুগ্ধপোষ্য জাত মাকে বলে—আপনি কীভাবে বোঝেন ওর খিদে পেয়েছে। একগাল হাসি দিয়ে বলেন, মা হলে সব বোঝা যায়। সত্যি মা আর সন্তানের সম্পর্ক সে যে বিনে সুতার মালা। সন্তান মায়েরই একাংশ। মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন। তাই তো সন্তানের কোনো বিপদ-আপদ হলে মা আগে জানতে পারেন। পৃথিবীর সব মা জাতির প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম।

(এএস/মে ০১, ২০১৪)