চৌধুরী আবদুল হান্নান


বিড়াল কেন ইঁদুর ধরে না? ইঁদুর আর বিড়াল যখন পরস্পর বন্ধু হয়ে যায়, বুঝতে হবে সর্বনাশটা আর বেশি দূরে নয়। প্রতিমাসে ২ লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে একজন নির্বাহী পরিচালককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল (সমকাল, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২১)।

পরিদর্শন বিভাগের কিছু কিছু কর্মকর্তা যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে পরিদর্শনে আসতেন, তারা নিয়মিত ঘুষ গ্রহণ করতেন এই শর্তে যে কোনো অনিয়ম বের হলেও তা রিপোর্ট করবেন না। তারা তো মধু খেয়েছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি ধরার কারণ নেই।

“কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হাইকোর্ট” শিরোনামে পত্রিকায় প্রকাশিত (সমকাল , ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২২) একটি খবর চোখে পড়েছিল। কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম- দুর্নীতির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছেন— “২০০২ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে যে সব কর্মকর্তা বসে বসে মধু খেত, তাই তারা চুপ থাকত।” এ সময় নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে “চোর” ও “ ডাকাত” বলেও উস্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।

লক্ষণীয় যে, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি বা অব্যবস্থা নিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ নতুন নয় বরং দীর্ঘদিন থেকে। একটু পিছনে তাকাই। মামলার শুনানিকাল ঋণখেলাপিদের উদ্দেশ্যে আদলতের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। “আগে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেন, পরে কথা বলুন, তা না হলে কারাগারে যেতে হবে।”

ঋণখেলাপি ব্যক্তির নির্বাচনে অংশ গ্রহণ বিষয়ে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করে হাইকোর্ট একবার বলেছিলেন, “নির্বাচনে অংশ গ্রহণের এতই যখন ইচ্ছা, তা হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ঋণ পরিশোধ করা উচিৎ ছিল।”

যেখানে ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্যের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংক ব্যবস্থা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে, আত্মসমর্পন করে বসে আছে, সেখানে শেষ ভরসা হিসেবে আদালত জেগে আছে অতন্ত্র প্রহরীর মতো।

সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী (এস কে সুর) ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম, তাদের অনৈতিক কাজ গোপন থাকেনি, এক সময় প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বিপুল অর্থ লোপাট মামলায় পলাতক আসামি পি কে হালদারকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্থাপক ৫৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমানিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে চাকুরিচ্যুৎ করা হয়নি, শাস্তি হিসেবে ২ টি বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বন্ধ করা হয়েছিল (“গুরু পাপে, লগু দন্ড” সমকাল ১৮ ফেব্রুয়ারী, ১৮)

নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যাদের প্রধান কাজ, সেই সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা যারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তারা ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপজ্জনক। আইন দ্বারা গঠিত স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত এ সংস্থাটি দুর্বল হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনীতির প্রধান খল নায়ক আর্থিক খাতের দুর্বলতা। সেক্ষেত্রে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সকল দুর্বলতা কাটিয়ে শক্তি অর্জন করার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা করা যায় না।

গভর্নর মহোদয় বাইরের চাপ সামলিয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, তা না হয় বুঝলাম, কিন্ত ঘরের শত্রুকে কেন দমন করতে পারবেন না?

বিভীষণদের চিহ্নিত করে নিজ ঘর পরিস্কার করতে হবে আগে; সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের যে কোনো মূল্যে সুরক্ষা দিতে হবে এবং সেটাই হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।