রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : এক সন্তানের জননীকে এ্যসিড মেরে ঝলসে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সোমবার রাত সাড়ে সাতটার দিকে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মহিষাডাঙা- হরিহরনগর সড়কের আজাহারুল ইসলামের মাছের ঘেরের পাশে এ ঘটনা ঘটে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই নারীকে রাতেই সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এসিডদগ্ধ নারীর নাম শাকিলা আক্তার (২৮)। তিনি সাতক্ষীরা শহরের রাজারবাগান এলাকার আলী মুরাদ আহম্মেদের স্ত্রী।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে মামা ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল মামুনের পাওনা ৫৬ লাখ টাকা ফেরৎ না দিতে ভাগ্নে তার স্ত্রীর শরীরে দাহ্য পদার্থ ছুঁড়ে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শাকিলা আক্তার জানান, তার বাপের বাড়ি তালা উপজেলার শাহপুর গ্রামের। বাপের বাড়ির পাশে সাহাপুর গোবরার বিলে তার স্বামী আলী মুরাদ আহম্মেদ ও কালিগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর গ্রামের মামা শ্বশুর ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল মামুন একই এলাকার সামছুল হক, মোজাম্মেল হক, সাঈদুজ্জামানসহ ১১ জনের কাছ থেকে ৬৭ বিঘা জমি লীজ নিয়ে ২০২৩ সাল থেকে ভেটকি মাছ চাষ শুরু করেন। ওই জমি তার মামা শ্বশুররের নামে চুক্তিপত্র করা ছিল। বছর শেষে লোকসান হওয়ায় মামা শ্বশুর আর ঘের করতে রাজী হননি। একপর্যায়ে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ওইসব মালিকদের কাছ থেকে বছর প্রতি সাড়ে ১২ হাজার টাকা ইজারা দেওয়ার শর্তে চার বছরের জন্য ওই ৬৭ বিঘা জমি ইজারা নেন তার স্বামী। এতে ক্ষুব্ধ ছিলেন তার মামা শ্বশুর আব্দুল্লা আল মামুন।

একপর্যায়ে মামা শ্বশুরের কাছের লোক বলে পরিচিত বোমা মোকছেদ, আমিনুর রহমান, পুলিশের দালাল শামীম খাঁ তাকে ও তার স্বামীকে জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি ধামকি দিয়ে আসছিল। নিরুপায় হয়ে তিনি (শাকীলা) গত ২২ জানুয়ারি সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ১৪৫ ধারায় পিটিশন-১১৫/২৪ নং মামলা দায়ের করেন। খেশরা ক্যাম্পের উপপরিদর্শক আব্দুল আলীম সোমবার বিকেলে ওই জমির তদন্তে যান। এরপরপরই মামা শ্বশুরের কাছের লোক বলে পরিচিত শামীম খাঁ তাকে শালিসের মাধ্যমে মীমাংসা করে নেওয়ার কথা বলেন। রাজী না হওয়ায় তাকে জীবনে মেরে ফেলার হুমকিসহ ঘের পাহারাদার হিসেবে বোমারু মোকছেদকে নিয়োগ করেন মামা শ্বশুর আব্দুল্লা আল মামুন। এরই অংশ হিসেবে সোমবার রাত সাড়ে সাতটার দিকে তিনি মহিষাডাঙা থেকে বাড়ি ফেরার সময় আজাহারুলের মাছের ঘেরের পাশে পিছন দিক থেকে এসিড জাতীয় কিছু ছুঁড়ে মারা হয়। এসিডে তার পিঠ ও ডান পায়ের পাতা ঝলসে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।
আলী মুরাদ আহম্মেদ জানান, নানার বাড়ির পাওনা ১৪ শতক জমি ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে মামা আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে বিরোধ ছিল তার। এরপর যৌথ ঘের নিয়ে মামার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। এ কারণে তার স্ত্রীর উপর এ্যসিড ছোঁড়া হয়েছে।

তবে কালিগঞ্জের ফতেপুর গ্রামের ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, শাহপুরে শ্বশুর বাড়ির পাশে তিন বিঘা খালে মাছ চাষ করতো ভাগ্নে আলী মুরাদ। ভাগ্নের পরামর্শে তিনি নিজে ঘের করার জন্য গত বছর তালার শাহপুর এলাকার ৬৭ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে ভাগ্নে আলী মুরাদকে দেখাশুনার দায়িত্ব দেন। সেখানে আলী মুরাদ তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে থাকতো। মাছ চাষ করা ছাড়াও নিজের প্রয়োজনে ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে টাকা নিয়েছে ভাগ্নে আলী মুরাদ। বিভিন্ন সময়ে ভেটকি মাছ বিক্রি ও তার কাছে পাওনা টাকা চেয়ে আসছিলেন তিনি। এরই মাঝে তার বাবা গত ৯ অক্টোবর মারা যান। গত ৩০ নভেম্বর টাকা দেওয়ার কথা বলে তার আগেই ঘেরের সকল মাছ বিক্রি করে দেয় আলী মুরাদ।

সর্বশেষ গত ২১ জানুয়ারি শাহপুর বাজারে এক শালিসে বসে তার টাকা পরিশোধের কথা ছিল। ডায়েরিয়া হয়েছে এমন কথা বলে শালিসে না যেয়ে ঘেরের ওই জমি নিজের দাবি করে স্ত্রী শাকিলা আক্তারকে বাদি করে ২২ জানুয়ারি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা করিয়েছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় শাহপুর বাজারে ওই জমি ও তার (মামুন) পাওনা ৫৬ লাখ টাকা নিয়ে শারিসি বৈঠকে থাকার কথা ছিলো আলী মুরাদের। সে না এসে সোমবার রাত সাড়ে সাতটায় তার স্ত্রীর উপর এ্যসিড ছুঁড়ে মারার নাটক সাজিয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান ওই ঘেরে থাকা একটি এসকেবেটর ম্যাশিন, চারটি গরু, ও কয়েকটি ছাগল আত্মসাৎ করার চেষ্টা চালাচ্ছে আলী মুরাদ। তিনি ঢাকায় অবস্থান করলেও মুরাদ তার নিজের একটি ছোট ঘেরে বিষ দিয়ে তার বিরুদ্ধে আড়াই লাখ টাকার মাছ ক্ষতি সাধনের অভিযোগ আনে থানায়।

শাহপুর গ্রামের শামীম খাঁ জানান, শালিসি বৈঠকে না এসে সোমবার রাত সাড়ে সাতটার দিকে আলী মুরাদ ও তার স্ত্রী যে এ্যসিড নিক্ষেপের নাটক সাজিয়েছে তদন্তে বেরিয়ে আসবে। আলী মুরাদের শ্যালিকা শাহারিয়ার বানু সোমবার বিকেলে শাহপুর বাজারের মোক্তাজুলের ঔষধের দোকান থেকে একটি সিরিঞ্জ কিনেছিলো। ওই সিরিঞ্জ এসিড ছোঁড়ার কাজে ব্যবহার হতে পারে। এ ছাড়া যে সময় এ্যসিড ছোঁড়ার ঘটনার কথা বলা হয়েছে সে সময় শালিসি বৈঠকের উদ্দেশ্যে খেশরা ক্যাম্পের আইসি শফিউল্লাহ, স্থানীয় ইউপি সদস্য সামছুল হুদা পল্টু, ঘের ব্যবসায়ি আব্দুল গফুরসহ অকেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ মাহাফুজ আনম জানান, দাহ্য পদার্থ ছুঁড়ে মারায় শাকিলা আক্তারের পিঠে ও ডান পায়ের পাতা ঝলসে গেছে। নিক্ষেপ করা দাহ্য পদার্থ এসিড কিনা তা পরীক্ষা না করে বলা যাবে না।

তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মোমিনুল ইসলাম জানান, শাকিলা আক্তার নামে এক সন্তানের জননী এসিডদগ্ধ হওয়ার ঘটনায় তার স্বামী আলী মুরাদ আহম্মেদ বাদি হয়ে কারো নাম উল্লেখ না করে ২০০২ সালের এসিড নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫(১)/৭ ধারায় একটি মামলা(৯নং) দায়ের করেছেন। ঘটনার সঙ্গে জডিড়তদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ৩০, ২০২৪)