আবীর আহাদ


আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ঘরে ফিরে গিয়েছিলাম। আমরাও মানুষ। আমাদেরও শান্তিপূর্ণ জীবন নিয়ে এদেশে বসবাসের অধিকার ছিলো। কিন্তু আমরা আমাদের সেই অধিকার পাইনি। আমরা আমাদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। যেহেতু আমরা দেশের নির্মাতা, সেহেতু আমরা আমাদের আত্মসম্মান ও মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে কারো কাছে হাত পাততে পারিনি। আমরা সরলভাবে বিশ্বাস করেছি যে, আমরা রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রই আমাদের জাতীয় মর্যাদার আলোকে আমাদের মোটামুটি উন্নত আর্থসামাজিক জীবন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেবে।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রের ওপর এমন একটি অন্ধ আস্থা রেখে আমরা দেশের দৃশ্যপট থেকে যার যার দিগন্তে ফিরে গিয়েছিলাম। তারপর জীবন থেকে বহুটি বছর কেটে গেছে। জীবনের পড়ন্ত বেলায় আমরা অনুভব করছি কী বিশুষ্ক শূন্যতায় আমরা অবগাহন করছি। আমাদের সবাই এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। আমাদের অনেক সাথী প্রতিদিন নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন। অধিকাংশের এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। রোগেশোকে অনেকেই বিছানায় পড়ে ছটফট করছে। চিকিত্সার অভাবে হা-পিত্যেশ করছে। এমনতর অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়ে তারা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে!

অথচ আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত পবিত্র দেশের মাটিতে কোথাকার কোন দরবেশ লোটাস সম্রাট খান কাজী বদি তারেক মামুন ফালু বাচ্চু মিঠু ভূঁইয়া জিকে শামিম, পাপিয়া, পাপলু, শাহেদসহ যেসব দুর্বৃত্ত মাফিয়া ডনরা অবাধে লুটপাটযজ্ঞ চালিয়ে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে----কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের রক্তের সাথে, চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে,তাদের মূলত: এই দেশে থাকারই অধিকার নেই ; অথচ বিভিন্ন সময় দুর্নীতি ও লুটপাটের সমর্থক সরকার তাদের জাতিদ্রোহ অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেয়ন! উপরন্তু তাদের যোগসাজশে সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও দুর্নীতি ও লুটপাটের সঙ্গী হয়েছে। দিনে দিনে সে-দুর্নীতি ও লুটপাট সাগরচুরি রূপ ধারণ করে আসছে।

বর্তমানে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একা সৎ থেকে দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছেন না। আসলে তিনিও যথোপযুক্ত লোকদের যথযথ স্থানে বসাতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং হচ্ছেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এখনো বহু সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ রয়েছে। তাদেরকে খুঁজে এনে দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে তাদের নিয়ে তিনি এক সর্বাত্মক দুর্নীতি ও লুটপাটবিরোধী অভিযান পরিচালনা করলে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে পারেন।

দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও মাফিয়াদের অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে। তাদেরকে আর কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেয়া যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে দুর্বৃত্ত মাফিয়া চক্রের পৃষ্ঠপোষক, আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা এবং সংকীর্ণমনা ও স্বার্থান্ধ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদেরও ক্ষমা করা যায় না। এরা তাদের ব্যক্তি ও চক্রের স্বার্থে দেশকে ধ্বংসের শেষ সীমানায় নিয়ে এসেছে। তাদের কারো ক্ষমা নেই।

দেশের সচেতন সৎ ত্যাগী ও জাগ্রত বিবেকবান সাহসী মানুষদেরকে আজ একজোট হয়ে ঐসব স্বার্থবাদী সংকীর্ণমনা সাম্প্রদায়িক অপরাজনৈতিক শক্তি এবং উদগ্র লুটেরা-মাফিয়াচক্রকে চিরতরে উৎখাত করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হবে। এটাই সতেরো কোটি মানুষের দাবি। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের দাবি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।