গোপাল নাথ বাবুল


বিনোদনের হাজারো মাধ্যমের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় মেলা হলো বইমেলা, যে মেলাকে উপলক্ষ করে মিলিত হন লেখকবৃন্দ ও পাঠকমহল। ১৯৭২ সালে মুক্তধারার প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্যোগে আমাদের দেশে বইমেলার সূচনা হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হয় বাংলা একাডেমি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।’ এছাড়া ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা’ও অনুষ্ঠিত হয়। বইমেলা একটি দেশের সাংস্কৃতিক মনোভাব তুলে ধরে। এটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সাহায্য করে এবং জ্ঞান অনুষদকে প্রশস্ত করে। বইয়ের সান্নিধ্য মানুষের অশান্ত মনে স্বর্গীয় সুখ এনে দিতে পারে। পৃথিবীতে অনুপম শ্রেষ্ঠ আনন্দ কেবল বইয়ের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়।

একঘেয়ে ক্লান্ত জীবনে বই এনে দিতে পারে সজীব প্রাণস্পন্দন। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত দার্শনিক ও সাহিত্যিক টলস্টয়কে জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু সম্পর্কে জিগ্যেস করা হলে তিনি বলেন, “জীবনে তিনটি বস্তু প্রয়োজন, তা হচ্ছে বই, বই আর বই।”

আর বই পড়া প্রয়োজন জ্ঞানসমৃদ্ধ হওয়া এবং আনন্দ লাভের জন্য। মানুষ আনন্দসন্ধানী। কেননা, আনন্দঘন জীবন স্বর্গ-সুষমায় ভরা। তাই মানুষ অমৃতের সন্ধান করে বইয়ের মাধ্যমে। নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপ আনন্দের জন্য মানুষের সামনে নীরব হৃদয় মেলে ধরে আছে অগণিত বই। আর এ অগণিত বইয়ের মধ্য হতে বেছে নিতে হবে, আমাদের কোন বই পড়া উচিত। যেমন- আমি যদি বাড়ি থেকে দোহাজারী স্টেশনে ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে রওনা দিই, তাহলে আমাকে আগে ঠিক করতে হবে, আমি কোন পথে যাবো। যদি আমি তা ঠিক না করে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করি, তাহলে আমার দোহাজারী রেল স্টেশনে যাওয়া হবে না।

ঠিক তেমনি আমাদের আগে ঠিক করতে হবে, আমরা কোন ধরণের বই পড়বো।এজন্য আমাদের মনে রাখতে হবে, সুষম খাদ্য যেমন আমাদের স্বাস্থ্যের বিকাশ ঘটায়, তেমনি আমাদের চিত্তের বিকাশ ঘটায় ভাল বই। যে বই শুধু তথ্য দেয় না, আমাদের উদ্বুদ্ধ হতেও শেখায়। যদি কোনো বই সেটা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, সে বই বাজে বই। সুতরাং আমাদের সে বই পড়া উচিত নয়।

বাংলা সাহিত্যের গদ্যরীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরীও ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে আনন্দহীন ও অন্তঃসারশূণ্য বই পড়ার কুফল সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছেন। বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের ধূর্ত লেখকদের বই এবং কাল্পনিক ও বাস্তবতা বিবর্জিত বই পাঠ করতে নিষেধ করেছেন। এক কথায় সেই বই পড়তে হবে, যে বই জীবনকে জানতে শেখায়। বই যারা পড়েন না, তারা জীবনে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হন। বিশেষ করে যাদের বয়স পনেরোর কম, তারা হয় পড়ার বইয়ের তলায় চাপা পড়ে থাকে নয়তো টিভি, মোবাইল, আইপ্যাড, ল্যাপটপে মনের আনন্দে ডুব দিয়ে থাকে। সেখানে রঙিন গল্প-ছড়ারা নড়ে চড়ে, কথা বলে। ফলে কিশোর-যুবাদের অডিও-ভিস্যুয়ালের নেশা বেড়েছে, কমেছে বই পড়ার আগ্রহ। তাই বই পড়ার আগ্রহ বাড়াতে এবং বইকে মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবী জুড়ে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে প্রধান হলো বইমেলা।

বই যে মানুষের মনের উন্নতি ও মনের চাহিদা মেটানোর জন্য কত প্রয়োজন তা জানা ও বোঝার জন্য ‘গেইম অব থ্রনস্’ সিরিজের চরিত্র টিরিয়ন ল্যানিস্টারের মুখ নিঃসৃত একটি বাক্য উদ্ধৃত করা যায়। তিনি বলেন,“একটি তরবারিকে যেমন ধারালো রাখার জন্য শাণপাথর দিয়ে শাণ দিতে হয় তেমনি মস্তিষ্ককেও শাণ দিতে হয় বই দিয়ে। এজন্যই বই পড়ি।”

কারণ, জ্ঞানার্জনের যত রকম পথ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম পথ হলো বই পড়া। তাই আমাদের ভাল বইগুলো পড়তে হবে। যেগুলো দ্বারা আমাদের জ্ঞানের শাণ দেওয়া যাবে। এমন বই পড়তে হবে, যে বই পড়লে মনের অন্তর্নিহিত প্রচ্ছন্ন শক্তি জাগ্রত হয় এবং মনোজগতের নানা ক্ষেত্র সমৃদ্ধ হয়। ফলে উৎসাহ ও আনন্দের মধ্য দিয়ে আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণা পরিতৃপ্ত হয়। অনেকে আবার বলেন, বই পড়ে কী লাভ ? আমার তো ধনের প্রয়োজন। কিন্তু ধনার্জনের জন্য জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন। কেননা, ধনের জন্য যদি কেউ ব্যবসা করতে চান, তাহলে তাকে অবশ্য বই পড়তে হবে। কারণ, ব্যবসা কীভাবে করে তা শিখতে হবে বই পড়ে। তাই বই পড়ার অভ্যাস যতই বাড়বে ততই সমাজের মঙ্গল। বই পড়ার অভ্যাস বাড়া মানেই অন্ধকার এলাকা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে জ্ঞানের আলো প্রসারিত হওয়া।
সুতরাং, বই এমন এক সঙ্গী, যে সবসময় নীরবে নিঃস্বার্থভাবে সঙ্গ দিয়ে যায়, বিনিময়ে কিছু দাবী করে না। অথচ আমাদের নিষ্কলুষ আনন্দের অর্ঘ্য দিয়ে জীবনকে করে তোলে উপভোগ্য। তাই আমাদের সুনির্বাচিত গ্রন্থাবলী পাঠ করা উচিত।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।