সরদার শুকুর আহমেদ, বাগেরহাট : বাগেরহাটে কাঠ দিয়ে তৈরি হচ্ছে শিশুদের জন্য পরিবেশ বান্ধব বাইসাইকেল। এসব সাইকেল বাংলাদেশের কোনো বাজারে খুঁজে পাওয়া না গেলেও সরাসরি রপ্তানী হচ্ছে ইউরোপের বাজারে। চাকা থেকে শুরু করে পুরো কাঠামোই কাঠ দিয়ে তৈরি করছে বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরীর ন্যাচারাল ফাইবার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। দেখতে খেলনা মনে হলেও দেশের বাইরে পরিবেশ বান্ধব এই ‘বেবি ব্যালেন্স বাইসাইকেল’ ব্যবহার হচ্ছে বাহন হিসেবে। দেশের অপ্রচলিত রপ্তানী পন্যে যুক্ত হওয়া নতুন এই সাইকেল তৈরির উদ্যোক্তারা এই বাইসাইকেল ছাড়াও কাঠ দিয়ে তৈরি করছেন সান বেড, হোটেল বেড, কুকুর-বিড়াালের খেলনাসহ পরিবেশবান্ধব আরও বেশ কিছু আকর্ষনীয় ফার্নিচার। তাও রপ্তানী হচ্ছে বিশ্ববাজারে। বেবি ব্যালেন্স বাইসাইকেল অপ্রচলিত রপ্তানী পন্যে হিসেবে ইউরোপের বাজারে রপ্তানীর পর সাড়া ফেলে দিয়েছে।  

বাগেরহাট শহরতলীর বিসিক শিল্প নগরীর ন্যাচারাল ফাইবার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাঠ দিয়ে বেবি ব্যালেন্স বাইসাইকেলটি তৈরি করছেন। প্রতিদিন এই ফ্যাক্টরিতে নিয়মিত-অনিয়মিত ৯০ থেকে ১২০ শ্রমিক কাজ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব শ্রমিকরা বাইসাইকেলটি ১১টি আলাদা অংশ তৈরি করেন। এদের মধ্যে কেউ চাকা তৈরিতে অভিজ্ঞ, কেউ তৈরি করেন সাইকেলের হ্যান্ডেল বা ফ্রেম। রং দিয়ে পলিশের পর এসব বাইসাইকেল আকর্ষনীয় করে তোলা হচ্ছে।

একটা বাইসাইকেল বানাতে গড়ে প্রায় ৮ ঘণ্টা সময় লাগে। এভাবে শ্রমিকরা প্রতিদিন ৩০টি বাইসাইকেল তৈরী করছেন। ফ্যাক্টরিতে শিল্পী রানি সরকার নামে একজন শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী স্বামীর আয়ে দুই মেয়ের লেখাপড়া করাতে পারছিলাম না। এক বছর ধরে এখানে বাইসাইকেল ফিটিংসের কাজ করছি। মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। এই আয়ে মেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের চাহিদা পূরণ হচ্ছে।

ন্যাচারাল ফাইবারের উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদ জানান, ২০০৫ সালে বাগেরহাট বিসিকে স্থাপন করে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে ম্যাট্রেস ছাড়াও কয়ার ফেল্ট, কোকো পিট, ডিসপোজেবল স্লীপারসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে দেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করতাম। বিগত কয়েক বছর নারকেলের ফলন কমে যাওয়ায় কাঁচামালের সমস্যা দেখা দেয়। এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে নতুন পণ্য ও কাস্টোমার খুঁজতে লাগলাম। গ্রীসের কোকো-ম্যাট নামের একটি প্রতিষ্ঠান পেলাম যারা পরিবেশ বান্ধব পণ্য বাজারজাত করেন। প্রথম দিকে তারা আমাকে কাঠের তৈরি ৪০ হাজার পিস বেবি ব্যালান্স বাইবাইকের চাহিদা দিল। আমি ও আমার ভাই সহ উদ্যোক্তা মোজাহিদ আহমেদ নেমে পড়লাম স্যাম্পল অনুযায়ী কাঠ দিয়ে বাইসাইকেল তৈরীতে। বাইসাইকেল তৈরীর পর তারাও পছন্দ করল। ইতোমধ্যে ২০ হাজার পিস বাইসাইকেল গ্রীসে পাঠানো হয়েছে, আরও ২০ হাজার পিস তৈরি হচ্ছে কারখানায়। এভাবেই কাঠের সাইকেল তৈরি ও রপ্তানির গল্প বলছিলেন তিনি। প্রতিটি বেবি ব্যালান্স বাইসাইকেল ১৮ ইউরো, কাঠের বিশেষ চেয়ার ১৭ থেকে ১৮ ইউরো, সান বেড ৫০ ইউরো ও হোটেল বেড ৫০ থেকে ৬০ ইউরো মূল্যে বিদেশে রপ্তানী করা হচ্ছে।

অপ্রজলিত পন্য রপ্তানীতে কিছু সংকটের কথা জানিয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, রপ্তানির জন্য সরকার আমাদেরকে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিতেন। এখন প্রণোদনা কমিয়ে দেয়ায় টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে। এছাড়াও নারকেলের ছোবড়া বা কাঠের কোনো পণ্য রপ্তানির করতে হলে ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট লাগে। ওই দপ্তরের অসহযোগিতাসহ পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজেও আমাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে এ ধরনের পরিবেশ বান্ধব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরকারের সার্বিক সহযোগিতা থাকে ইউরোপের রপ্তানী বাজার বাংলাদেশী উদ্যোক্তরা দখল করতে পারবে বলেও জানান তিনি।

গ্রীসের কোকো মাট কোম্পানির প্রজেক্ট ইনচার্জ মিস এভা বলেন, বাংলাদেশে তৈরি এই কাঠের বাইসাইকেল বিশ্বের সেরা বাইক। এটা একদম স্থানীয় পণ্য দিয়ে তৈরি হয়। এই বাইকের বেশ চাহিদা রয়েছে গ্রীসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ন্যাচারাল ফাইবারের সাথে ব্যবসা আরও সম্প্রসারণ করা হবে বলেও জানানতিনি।

বাগেরহাটের বিসিক কর্মকর্তা শরিফ সরদার বলেন, বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরীতে মুস্তাফিজুর রহমান সব সময়ই ইউনিক আইডিয়ায় নিয়ে কাজ করেন। বর্তমানে কাঠের বাইসাইকেল তৈরি পর তা রপ্তানী করে ইউরোপ জয় করছেন। এসব অপ্রচলিত পন্য রপ্তানীতে কিছুটা সমস্য থাকলেও তা কাটিয়ে উঠতে বিসিক কাজ করছে।

(এস/এসপি/মার্চ ০১, ২০২৪)