আম্বিয়া বেগম : আমেরিকার সময় দুপুর ২ টা। নভেম্বর ১২, ২০১৪। সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট নিয়ে তিনদিন নিদ্রাহীন অবস্থায় কর্মস্থলে অবস্থান করছিলাম। খাওয়া, অফিসের ও বাড়ির কাজকর্ম মন নেই। মানসিক কষ্ট আর দুশ্চিন্তায় কাটছিল প্রতিটি অস্থির মূহুর্ত।

ওই সময়ে মোবাইলে অজ্ঞাত নম্বর থেকে অসংখ্যবার ফোন। কিন্তু ফোনটা রিসিভ করার মত মানসিক শক্তিও নেই আমার। অবশেষে আমার পরিচিত প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ওয়ান থেকে ফোন করে একজন বললেন, মিস আম্বিয়া তোমাকে মোবাইলে খুঁজছে একজন। তুমি ফোনটি ধরো। কিছুক্ষণ পরই সেই অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে বলা হলো, হ্যালো আর ইউ বেগম ? বললাম রাইট। প্রতিউত্তরে সে বলল তোমার হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ, টাকা সহ বৈধভাবে আমেরিকায় বসবাসের মূল্যবান কাগজপত্র আমি পেয়েছি। যা তোমাকে দিতে চাই। বল তুমি কোথায় ? আমি সেখানেই যাব।

তারপর ট্রেনে ফেলে যাওয়া ব্যাগ সহ মূল্যবান সম্পদ ফিরে পাওয়ার আনন্দটা লিখে জানানোর মত ভাষা আমার জানা নেই। তবে, এই আনন্দ ও হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ ফিরে পাওয়ার ঘটনাটা আমার কাছে নৈতিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। যা আমাকে বিস্মিত ও হতবাক করেছে।

এজন্য চিরকৃতজ্ঞ আমি আইরিশ আমেরিকান নাগরিক মিসেস চার্লি খানের প্রতি। আমেরিকার নিউইয়ার্কে ব্রঞ্জ সিটিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন তিনি। হারানো ব্যাগ নিয়ে তিনদিন হন্যে হয়ে খুঁজেছেন আমাকে। ঠিকানা খুঁজে অফিসে গেছেন। অবশেষে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে ষাটোর্ধ্ব বয়সী চার্লি যখন সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তখন আনন্দের বদলে চোখে জল নেমে আসে।

গত ১০ নভেম্বর সোমবার বিকালে ৫ টার সময় ব্যাগটি হারিয়ে যায়। ওইদিন কর্মস্থল থেকে ট্রেনযোগে বাড়ি ফেরার পথে মনের ভুলে ব্যাগ ট্রেনে রেখেই নেমে পড়ি। এর কিছুক্ষণ পর মনে হলো ব্যাগের কথা। তৎক্ষনাৎ ব্যাগের সন্ধানে চারিদিক খোঁজাখুজি করি। পরদিন নির্দিষ্ট ট্রেন লস হোমে যায়। খোঁজ করি। পুলিশকে বলি। নিউইয়র্কের আশপাশের ৪ টি শহরের বিভিন্ন লস হোমে যায়। সেখানেও পুলিশকে বলি।

কিন্তু কেউই ব্যাগের সন্ধান দিতে পারেনা। বন্ধুবান্ধবী সকলকে ঘটনাটি বললে তারা সকলেই ব্যাগ ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু যে ব্যাগে আমার প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ, বেতনের চেক ছাড়াও দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অর্জন এমন মূল্যবান কাগজ ও পরিচয়পত্র, সেই ব্যাগ হারানো কষ্ট ভুলি কিভাবে ?

প্রচন্ড মনকষ্টের এই মূহুর্তে আমার পরিচিত একমাত্র অনুপ কুমার বললো, আপা কোন আমেরিকান পেলে ওই ব্যাগ আপনি অবশ্যই পাবেন। আপনি দু:শ্চিন্তা ছেড়ে একটু খান এবং ঘুমান। দেখেন ব্যাগ ফিরে পাবেন। অবশেষে সেই অবিশ্বাস্য সান্তনার কথা বাস্তবে রূপ নিল।

১২ নভেম্বর দুপুরে অফিসে বসে আছি। ফোনালাপের পরামর্শমত আমি চার্লির কাছে ছুটে যাই। বয়সের কারণে চার্লিকে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। এত কষ্ট নিয়েও তিনি সেই ষ্টেশনে, যেখানে আমি ট্রেন থেকে নেমে গিয়েছিলাম। চরম উত্তেজনা নিয়ে ষ্টেশনে পৌঁছাই। কিন্তু দুজনে দুজনকে চিনবো কিভাবে? এই ভাবনা ভর করছিল মনে। ট্রেন থেকে নেমেই দেখি আমার ব্যাগ ঘাড়ে একজন বয়স্ক ভদ্র মহিলা অপেক্ষা করছেন। দুরু দুরু মন নিয়ে ব্যাগে হাত দিতেই তিনি বুঝে গেলেন আমিই সেই বেগম।

ওইদিন বিকালেই তাঁকে নিয়ে যাই পাশেই ম্যাগডোনালস খাবার দোকানে। সেখানে তিনি কিভাবে ব্যাগটি পেলেন, কিভাবে আমার খোঁজ করলেন এবং ব্যাগটি পৌঁছে দিতে তিনি কত জায়গায় গেছেন, গল্প শুনে চার্লির প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধায় মনটা ভরে গেল। তিনি অক্ষত অবস্থায় ব্যাগে রক্ষিত সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দিলেন।

অথচ কর্মব্যাস্ত জীবনের চলাফেরার পথে ভীনদেশে বহুবার বহুকিছু হারিয়েছি। কিন্তু কিছুই পাইনি। তাই এ পাওয়া আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় ও আনন্দের। ধন্যবাদ বন্ধু চার্লি খান। দীর্ঘায়ু হও তুমি।

লেখক : নিউইয়র্ক, আমেরিকা প্রবাসী।