চৌধুরী আবদুল হান্নান


দেখার কেউ নেই, যারা দেখার তারাও দেখে না। একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক যখন একাধিক ব্যাংকে ৬০০ কোটি টাকার ওপর ঋণ খেলাপি থাকেন, তার তো আর কোনো ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকে না। কিন্ত টাকার নেশা বড় নেশা; সেই নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিই তার দুই কর্মচারীকে মালিক সাজিয়ে এবি ব্যাংক থেকে ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ কৌশলে অনুমোদন করিয়ে নেন। কিন্ত বিধিবাম, ঋণ ছাড় করার আগেই আটকে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

এ রকম বেনামি ও ভুয়া ঋণ, ঋণের টাকা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার সংক্রান্ত নানা খবর পত্রিকায় প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে কিন্ত এর কোনো প্রতিকার হয়েছে — এমন খবর চোখে পড়ে না। অপকৌশলের মাধ্যমে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বের করে নেওয়া বিপুল পরিমান অর্থের কত অংশ মুদ্রা বাজারে প্রবেশ করে দ্রব্যমূল্যে চাপ সৃষ্টি করছে আর কত অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে , তার কোনো হিসাব কোথাও নেই। তবে মাঝে মাঝে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় মাত্র।

গবেষক ও অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ পাচারের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রাক্কলনে উঠে এসেছে, দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়।”

অন্যদিকে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ব্যাংক খাত তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে।

অর্থ পাচার, বেনামি ঋণ , ভুয়া ঋণ এখন লাগামহীন আর যারা এসব অনৈতিক কাজ প্রতিকারে উদ্যোগী হবেন, তারা যেন ঘুমিয়ে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক সংসদে দেওয়া বক্তব্যে দাবি করেন, ব্যাংক তো খালি হয়ে গেছে। তবে বাস্তবতা হলো, ব্যাংক এখনো খালি হয়ে যায়নি কিন্ত ক্রমশ খালি তো হয়ে যাচ্ছে। আমরা বুঝতে পারি তিনি ব্যাংক খাত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং দুরবস্থা দেখে দেখে জাতীয় সংসদে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

ফরিদপুর-৩ আসন থেকে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত এ কে আজাদ সংসদে তাঁর প্রথম বক্তব্যে ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচার বিষয়ে যে বক্তব্য দেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, যারা ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেনি, পাচার করেছে, বিদেশে বেগমপাড়া-সেকেন্ডহোম বানিয়েছে, তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচারের আওতায় আনা এবং জাতীয় সংসদে তাদের তালিকা প্রকাশ করার দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, যারা ব্যাংক লুট করেছে তারা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী, এদের আইনের আওতায় আনা না গেলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে না (সমকাল ১৩/০২/২৪)।

ব্যাংকগুলোর কিছু সরকারি মালিকানার আর বেশির ভাগই সরকার অনুমোদিত ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং সে কারণে সবই বৈধ প্রতিষ্ঠান কিন্ত এর মাধ্যমে যত অবৈধ আর অনৈতিক কর্মকান্ড চলমান।

এভাবে ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া টাকাটা খারাপ টাকা বা কালো টাকা; খারাপ টাকা ভালো কাজে নয়, খারাপ কাজেই ব্যবহার হয়।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যখন সক্ষমতা হারায়, তখন বিষয়টি জাতীয় সংসদে আলোচনা করা জরুরি বলে অনেক সচেতন নাগরিক মনে করেন। তাতে দেশের জনগণ অন্তত জানতে পারবে, কারা সম্পদ লুট করছে আর অর্থনীতিতে রক্তশূন্যতার জন্য কারা দায়ী। আমাদের সহজে হুঁশ হয় না, সর্বনাশটা যখন ঘটে, কেবল তখনই টনক নড়ে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।