গোপাল নাথ বাবুল


মানুষের ৫টি মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও খাদ্য। এর মধ্যে খাদ্য হলো একটি প্রধান ও অন্যতম চাহিদা। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে কিছু অসাধু ও বিবেকহীন ব্যবসায়ীর কারণে বিশুদ্ধ খাদ্য আজ স্বপ্ন হয়ে ওঠেছে মানুষের কাছে। দুষিত ও বিষযুক্ত খাবারকে নিয়তি হিসেবে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই। 

সম্প্রতি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার খবরে প্রকাশ, সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করা কয়েকজন মৌয়াল সাড়ে ৭ কেজি চিনি-সহ ধরা পড়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। কারণ কী! সুন্দরবনে কেন মৌয়ালরা চিনি নিয়ে যাবে! লাখ টাকার একটা প্রশ্ন। নিশ্চয় তারা দু’নম্বর মধু তৈরির জন্য চিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন। চাকুরি জীবনের প্রথমে এমন একটা কোম্পানীতে কয়েকমাস চাকুরি করার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। যেখানে চট্টগ্রাম শহরের বদরপাট্টি থেকে বিভিন্ন কেমিক্যাল কিনে ২ নম্বর মধু, ঘি, পাইন-আপেল, এনার্জি ড্রিংক, রোহ আফজা-সহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হতো। ২ মন সাইজের বড় পাতিলে পানি গরম করে চিনি, মধুর রঙ ও কেমিক্যাল মিশিয়ে কীভাবে সুন্দরবনের খাঁটি মধু তৈরি করা হতো, তা নিজের সচক্ষে দেখেছি। সময়মতো পুলিশের মাসিক সম্মানি থানায় পৌঁছাতে দেরি হলে পুলিশের অভিযানও চলতো মাঝে-মধ্যে। অভিযান চালিয়ে পুলিশ মনে করিয়ে দিতো, থানার অফিসারদের মাসিক সম্মানি সময়মতো না পৌঁছালে এভাবেই অভিযান চলবে এবং ১ টাকার স্থলে ৫০ টাকা খরচ হবে। তাই পত্রিকায় চিনিসহ মৌয়াল ধরা পড়া খবরটি দেখে আমার সেই সময়ের কথা মনে পড়ে গেল। রমজানের আগে শরীয়তপুর থেকে মাত্র ২ টিন ঘি এনে পামঅয়েলের সাথে কেমিক্যাল মিশিয়ে সামান্য পরিমাণ ঘি দিয়ে শত শত কেজি খাঁটি ঘি তৈরি করা হতো, যা খেলে সুস্থ মানুষেরও পেটের ব্যাথা শুরু হয়ে যেতো। যা এখনো চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন অলি-গলিতে চলমান রয়েছে।

আমরা একেবারে জেনে-বুঝেই সামান্য মুনাফার লোভে এভাবেই নিজেদের একটি আত্মবিধ্বংসী জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছি। প্রতিটা খাদ্যে রয়েছে ভেজাল। এমন ভেজাল মিশানো হচ্ছে, যা খেয়ে শিশুরাও ক্যান্সারের মতো মারণ রোগে সংক্রমিত হচ্ছে। এমন কোনও খাদ্য নেই যাতে ভেজাল নেই। যেমন-দুধে ফরমালিন, গরুর দুধ বৃদ্ধিতে পিটুইটারী গ্ল্যান্ড ইনজেকশান দেওয়া হয়। দুধে শুধু ভেজাল দিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছেন না এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। তারা এবার নকল দুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন। এ দুধ তৈরিতে কোনও গাভীর প্রয়োজন পড়ে না এবং কষ্ট করে গড়ে তুলতে হয়না গবাদি পশুর খামার। ছানার ফেলনা পানির সঙ্গে থাইসোডা, পার অক্সাইড, ময়দা, ভাতের মাড় ও চিনি-সহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে আগুনে ফোটানো হয় এবং পরে কার্টিং অয়েল ও এসেন্স মিশিয়ে দুধের সুবাস দেওয়া হয় অথবা গরম পানির সঙ্গে অ্যারারুট ও কয়েক প্রকার রাসায়নিক পাউডার মিশিয়ে সহজেই তৈরি করা হয় এক নম্বর খাঁটি দুধ নামের বিষ এবং দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে মিশানো হচ্ছে ফরমালিন। ফলে এর কুফলের শিকার হচ্ছেন পূর্ণ বয়স্ক থেকে শিশুরা। চিকিৎসকরা বলছেন, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি এসব নকল দুধ পানের কারণে ডায়রিয়া, জটিল পেটের পীড়া, কিডনি ও লিভার রোগে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও মারাত্মক।

মাছে ফরমালিন ব্যবহার করা হয় দীর্ঘদিন তাজা রাখার জন্য। ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়, ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ফরমালিনকে দায়ী করে।

শাক-সব্জি টাটকা রাখতে কপার সালফেট। আম, লিচু, জাম, কলা পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং সংরক্ষণে ফরমালিন-সহ অহরহ ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত কেমিক্যাল। ফল গাছে থাকতেই হরমোন কীটনাশক, তরমুজকে লাল দেখানোর জন্য সিরিজ দিয়ে দেওয়া হয় পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট। কপিতে দেওয়া হয় তেঁতুলের বিচির গুড়া। গাছে ফল আসা থেকে বাজারে বিক্রি করা পর্যন্ত কমপক্ষে ৬ দফা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মূলত গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করার কারণেই ফলগুলো রীতিমতো বিষে পরিণত হয়। ইথালিন অথবা ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারের কারণে কয়েকদিনের মধ্যেই ফল হলুদ রঙ ধারণ করে। যদিও বাস্তবে এসব ফল অপরিপক্ক। অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড মেশানোর ফলে আমগুলো মূলত ক্যালসিয়াম সায়নাইডের মতো মারাত্মক বিষে পরিণত হতে পারে।

দীর্ঘক্ষণ মচমচে রাখার জন্য জিলিপি ও চনাচুরে দেওয়া হয় পোড়া মবিল। আকর্ষণীয় আইসক্রিম, সেমাই, বিস্কুট, নুডলস ও মিষ্টিতে দেওয়া হয় কাপড় ও চামড়ায় ব্যবহার করা রঙ। ফলের রস তৈরি হয় কেমিক্যাল দিয়ে। বিদেশি বিভিন্ন মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্য, ঔষুধ, কেমিক্যালস্-এ নতুন মেয়াদের স্টীকার লাগানো হয়। সবুজ ফল, শাক-সব্জিতে কাপড়ের সবুজ রং ব্যবহার করা হয় যাতে টাটকা ও কালারফুল দেখায়। জুস, লাচ্চিতে উচ্চমাত্রার প্রিজারভেটিভ, সরিষার তেলে ঝাঁঝালো কেমিক্যাল, শুটকী সংরক্ষণে কীটনাশক, নেইল পালিশ, লোশন, পারফিউম-সহ বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীতে ব্যবহার করা হয় লেড মার্কারি, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, থেলেট ইত্যাদি, যাতে স্তন ক্যান্সার ও বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দেওয়ার মতো উপাদান রয়েছে। এছাড়া চাল চকচকে ও মুড়িকে ধবধবে সাদা এবং বড় করতে ব্যবহার করা হয় হাইড্রোজ ও ইউরিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাজমেরী এস এ ইসলাম বলেন, ইউরিয়া ও হাইড্রোজ হচ্ছে এক ধরনের ক্ষার। এগুলো পেটে গেলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেপটিন এসিড তৈরি করে যা ক্ষুধামন্দা, খাবারে অরুচি, বৃহদান্ত ও ক্ষদ্রান্তে প্রদাহ-সহ নানা রকম শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে।

জীবন রক্ষাকারী পানি নিয়ে সারাদেশে চলছে মরণঘাতী খেলা। যে কোনও পানিকে পার-অক্সাইড দিয়ে নামমাত্র ধুয়ে বিশুদ্ধ বোতলজাত পানি তৈরি করা হয়। যত্রতত্র নকল কারখানা সৃষ্টি করে পুকুর, ডোবা এবং ওয়াসার পানি বিশুদ্ধকরণ ছাড়া বোতলজাত করেই বিশুদ্ধ মিনারেল পানি বলে বাজারজাত করা হচ্ছে। সারাদেশের বাসা-বাড়ি-সহ, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩ শতাধিক বোতলজাত পানির জার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৯টি। এ ব্যাপারে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, কোনও রকম অনুমোদন ছাড়াই ওয়াসার সরবরাহ লাইনের পানি গামছায় ছেঁকে বোতল ভরে বাণিজ্য করা হচ্ছে।

মসল্লায় ইটের গুড়া ও মেটালিক অক্সাইড, হলুদে মিশিয়ে দেয় লেড ক্রুম্যাড লেড আয়োডাইড। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাইয়ের মিয়াখাননগর এলাকায় একটি মসলা তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রঙ, কয়লা, ইটের গুঁড়া, কাঠের গুঁড়া এবং নিম্নমানের ভূষি মিশ্রিত নয়শ’ কেজি ভেজাল গুঁড়া মসলা জব্দ করেছে। এ কারখানায় মূলত মরিচের গুঁড়া ও হলুদের গুঁড়া তৈরি করা হচ্ছিল। প্রতিবছর রমজানের আগে অধিক মুনাফার লোভে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এসব কুকর্ম করে থাকে। কাপড়ের ক্ষতিকারক রঙ ও ধানের তুষ মিশিয়ে তৈরি করা হয় গুঁড়া মসলা, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বেশ কয়েকমাস আগে র‌্যাবের নেতৃত্বে বাকলিয়ার চাক্তাই এলাকায় ভেজাল গুঁড়া মসলা তৈরির এক ক্রাসিং মিলে অভিযান চালিয়ে ক্ষতিকর রঙ মেশানো প্রায় ছয়শ’ কেজি ভেজাল হলুদ, মরিচ ও ধনিয়ার গুঁড়া এবং ১২ কেজি রঙ ও রাসায়নিক পদার্থ জব্দ করা হয়। এ ঘটনার মাসখানেক পর একই এলাকায় নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করে অননুমোদিত ৩৫০ কেজি লাল রঙ, হলুদ রঙ ২০০ কেজি এবং তুষ-কুড়া ২৫০ কেজি। স্থানীয় জনগণ বলছেন, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর নজরদারির অভাবে নগরীর বাকলিয়া এলাকায় একাধিক ভেজাল মসলার কারখানা গড়ে তুলেছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। প্রতিবছর রমজানকে সামনে রেখে বেশি লাভের আশায় ভেজাল গুঁড়া মসলা, নকল ঘি, মধু-সহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। এমনকি বড় বড় কোম্পানীগুলোও কম যায় না। তাদের উৎপাদিত, প্যাকেটজাত, প্রক্রিয়াজাত তরল ও কঠিন খাদ্যের অধিকাংশই বিষ ও ভেজালে ভরপুর। যেমন-ফলের রস, স্নাকফুড, গ্রীনপী, জ্যাম-জেলী, আচার-চাটনীতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রং ব্যবহার করা হয়।

পুষ্টিবিদদের মতে, ভেজাল মসলা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কাপড়ের রঙে মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। কপার, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামের মতো ক্ষতিকর ধাতু মিশে থাকে এসব রঙে। যা মানুষের অপুষ্টি, খাদ্যজনিত বিষক্রিয়া, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন স্ট্রোক, লিভার, কিডনি রোগ সৃষ্টি করে। শরীরে ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধি করে। যকৃৎ অচল হয়ে পড়ে। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া, কাঠ ও কয়লার গুঁড়া তো কোনও প্রাণীর খাবার নয়। মানুষ তা খেলে হজম করতে পারে না। ফলে হজম প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়ে মানুষের পাকস্থলী ও কিডনি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। যার চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে রোগীর পরিবার-পরিজন সর্বশান্ত হচ্ছে। তাছাড়া রাষ্ট্রকে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

আরও অভিযোগ আছে, উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে বেশি লাভের আশায় দেশের বিভিন্ন বেকারির খাদ্যপণ্যে ভেজাল আটা, ময়দা, ডালডা, তেল, পঁচা ডিম-সহ নিম্নমানের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়। কেক ও রুটি তৈরিতে মেশানো হয় পিপারমেন্ট, সোডা ও ব্রেকিং পাউডার। বেকারির কারখানায় উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য সতেজ রাখতে ট্যালো, ফ্যাটি, এসিড ও ইমউসাইল্টিং, টেক্সাইল রঙ-সহ নানা কেমিক্যালও ব্যবহার করা হয়। বেকারির খাদ্যপণ্যে পঁচা ডিম ব্যবহার যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু মানবখাদ্যেই নয়, ইদানীং পশুখাদ্যেও ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। মাছ, পশু ও হাঁস-মুরগীর ফিড তৈরি হয় চামড়া শিল্পের বর্জ্য দিয়ে। এসব বর্জ্যে রয়েছে মাত্রারিক্ত ক্রোমিয়াম, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব মাছ, হাঁস-মুরগী ও পশুর মাংস রান্ন করলেও এ ক্রোমিয়াম নষ্ট হয়না। এছাড়া, খামারের হাঁস-মুরগী ও মাছ চাষে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম লেড আর অ্যান্টি-বায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে দেশের বিভিন্ন বাজারে পোলট্রি ফিড, কুড়া, ভুষি, খৈল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের কারণে হাজার হাজার মৎস্য, দুগ্ধ , হাঁস-মুরগির খামার আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। এসব অসাধু ব্যবসায়ী কুড়ার সঙ্গে কাঠের গুঁড়া, ধানের তুষ, আটা, খৈলের সঙ্গে কালো পোড়া মাটি, পোড়া মবিল ও দালানের মেঝেতে ব্যবহৃত কালো রঙ ইত্যাদি মিশিয়ে বাজারজাত করছে। এমনকি পশুপাখির চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ঔষধও ভেজাল ও নিম্নমানের। এতে একদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্যের চরম ক্ষতি হচ্ছে অপরদিকে ভালো কোম্পানীগুলোর সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন অফিসের সম্মেলন কক্ষে ‘বাংলাদেশে অধিক বিপজ্জনক কীটনাশক এবং রাসায়নিকের উন্নত ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘খাবার কি উপায়ে উৎপাদন করা হচ্ছে এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে বাজারের ৭০ শতাংশ খাবারে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণেই এটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলস্বরূপ নানা মারণব্যাধী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে দেশের মানুষ। সবাই সচেতন না হলে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে খাদ্যের গুণগত মান বৃদ্ধিতে বিস্তর পরিসরে কাজ করতে হবে।’

কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্যগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের ১৬ ভাগ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আইসিসিডিআরবি’র তথ্যমতে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাদের এক সমীক্ষায় প্রমাণ পেয়েছে, প্রায় প্রতিদিন ৫০১ জন মানুষ ডায়রিয়াজনিত কারণে হাসপাতালে আসে, যার পেছনে ভেজাল খারারই দায়ী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এ ভেজাল দমনে নানাবিধ আইন প্রণয়ন করেছে। ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ২৭২ ও ২৭৩ নং ধারা, বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯, বিশুদ্ধ খাদ্য নীতিমালা ১৯৬৭, বিএসটিআই আইন ২০০৩, ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ ২০০৯, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ সহ অনেক আইন প্রচলিত রয়েছে। এ সমস্ত আইনে আদালত ন্যূনতম ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং ন্যূনতম ১ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড আরোপ করতে পারে।

এতকিছুর পরেও সরকার অসাধু ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে জেনেশুনেই কিংবা অজ্ঞতাবশত আমরা ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করছি এবং জীবননাশের ঝুঁকি বাড়িয়ে নিজেদের একটা আত্মবিধ্বংসী জাতি হিসেবে গড়ে তুলছি। তাইতো কালজয়ী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘মিঠে কড়া’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া ‘ভেজাল’ কবিতার শেষের দু’চরণ উদ্ধৃত করছি, যাতে কবি বিংশ শতাব্দীতে এ উপমহাদেশের ব্যবসায়ীদের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরেছিলেন- ‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে, ‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে। কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই, ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।