শ্রুতিলিখন : শঙ্করী দাস : শুরু থেকে স্বাধীনতার চেতনার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল আমাদের গফরগাঁও। ফেব্রুয়ারি থেকে গফরগাঁও ছিল তুঙ্গে। আন্দোলনে গফরগাঁও দেশের অন্য এলাকা থেকে পিছিয়ে ছিল না। বরঞ্চ অনেক অঞ্চল থেকে ছিল এগিয়ে। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। কিন্তু স্বাধীনতার চেতনা তখনই আমার রক্তের সাথে মিশে গিয়েছিল। এতটাই উজ্জ্বীবিত ছিলাম যে, ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে বড় ভাই, দুলাভাই ও দুলাভাইয়ের ভাইদের সাথে উপস্থিত হয়েছিলাম রেসর্কোস ময়দানে। সেদিন রেসর্কোস ময়দানে দাঁড়িয়ে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম আমি।

২৫ মার্চ পরিবারের সাথে আমি আমার পৈতৃক নিবাসেই ছিলাম। পরদিন সবার সাথে বিবিসির খবর শুনে ও বড়দের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তখন একমাত্র সঠিক খবরের মাধ্যম ছিল বিবিসি। সকালে বিবিসির খবরে সবাই কেমন মুষড়ে পড়ল। সবার মুখ হয়ে গেল থমথমে। সবাই কেমন ভীত বিহ্বল। ক্রমে লোকমুখে ঢাকার নির্মম হত্যাযজ্ঞের খবর আসতে লাগল। আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তারা কী করণীয় ভাবতে শুরু করলেন। সারাদেশের আতঙ্ক আর অস্থিরতার খবর আসতে লাগল। এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। ইতোমধ্যে দেশের পরিস্থিতি চলে গেল ভয়াবহ অবনতির দিকে। এপ্রিলে পাঞ্জাবীরা মশাখালি বাজার ও তা থেকে চার কিলোমিটার পশ্চিমে মুখী বাজারে ক্যাম্প স্থাপন করল। এ অবস্থায় আশেপাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামগুলোর ছাত্র ও যুব সমাজ সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে একদিন রাতে সবাই একত্রিত হলো আমাদের বাড়িতে। মধ্যরাতে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই উঠে দাঁড়ায় শপথ নিতে। হাতে হাত রেখে সবাই শপথ গ্রহণ করে। শপথ ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত দেশকে মুক্ত না করতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার। প্রয়োজনে আজীবন লড়াই করবে এবং জীবন উৎসর্গ করবে। দেশকে শত্রু মুক্ত না করে ঘরে ফিরবে না। সেই শপথের ভাষা আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চেহারা আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে।

ইতোমধ্যে মুসলিমলীগ পন্থানুসারীরা পাকিস্তান ভাঙ্গা যাবে না বলে শপথ নিয়েছিল এবং পাঞ্জাবীদের সাথে হাত মেলানোর চিন্তা করেছিল। সংগঠিত ছাত্র যুবকদের পরদিন ভারতের উদ্দেশে ট্রেনিং নিতে চলে যাওয়ার কথা ছিল সকাল দশটায়। তারা আমাদের বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এদের অবস্থান মুসলীমলীগের কেউ গোপনে জানিয়ে দেয় মশাখালি ক্যাম্পে। সকাল নয়টার দিকে পাঞ্জাবীরা আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। চারজন ধরা পড়ে যায়। বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ধৃত চারজনকে নিয়ে গেল মুখীবাজার ক্যাম্পে। আনুমানিক বেলা বারোটার দিকে মুখী ও মশাখালির মাঝখানে শিলা নদীর পাড়ে তাদের নিয়ে আসে। আমি তখন স্কুল থেকে চাচার সাথে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম। চাচা ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। স্কুলে ছাত্র হাজির থাকতো না বললেই চলে। কিন্তু ক্লাস হোক বা না হোক নির্দেশ ছিল স্কুল খোলা রাখার। আমরা নদীর কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম সেই চারজনকে পেছনে হাত বেঁধে নদীর পাড়ে নিয়ে এসেছে। তাদের নদীতে নামতে বলছে। বাঁচার শেষ চেষ্টায় তারা নদীর কিনার ঘেঁষে ঝোঁপে ঝাড়ে আশ্রয় নেয়। পাঞ্জাবীরা ঝোঁপে গুলি চালায়। বাধ্য হয়ে তারা বেরিয়ে আসে। তখন ওদের রাইফেলগুলো গগন বিদারী আওয়াজ তুলে গর্জে ওঠে। চারজনই একসাথে নিহত হয়। রক্তে নদীর জল লাল হয়ে যায়। শিলানদীর উপর কাঠের ব্রীজে দাঁড়িয়ে আমি আর সহপাঠী এক চাচাত ভাই সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি। একজন শিক্ষকও ছিলেন আমাদের সাথে।

যারা পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন সবাই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে দু’জন যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়েছেন। চার পাঁচজন পঙ্গুত্ব বরণ করে আজও জীবিত আছেন। যারা ধরা পড়ে গিয়েছিলেন তাদের ভেতর একজন ছিলেন দলের নেতা। তার কাছে যুদ্ধে অংশ নিতে সংগঠিত শপথ গ্রহণকারীদের নামের তালিকা ছিল। সেই তালিকা অনুসারে প্রত্যেকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।

গ্রামের বয়স্ক পুরুষ, মহিলারা শুধু বাড়িতে থাকত। নজর রাখত পথের দিকে। পাঞ্জাবীরা গ্রামে ঢোকার টের পেলে পালিয়ে যেত। আমাদের পরিবারের মত আরো অনেক পরিবারের মেয়েদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে গাড়ী যাওয়ার রাস্তা ছিল না। গ্রামের কেউ কেউ আবার বাঙ্কারও তৈরি করেছিল। দিনের বেলায় গোলাগুলির সময় আমরা চলে যেতাম বাঙ্কারে। দিনে রাজাকার বাড়িতে এসে মুরগী, ছাগল, ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেত। রাতে গ্রামবাসী সাহায্য করত মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রস্তুত রাখত খাবার। মাছ, মুরগী, ডাল, ভর্তা এক একদিন এক এক রকম খাবারের আয়োজন রাখা হত। যাতে যোদ্ধারা অভুক্ত না থাকে।

যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মশাখালি গ্রামে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। গ্রামে ঢুকে হঠাৎ একটি বাড়ি থেকে চারজন তরুণীকে তুলে নিয়ে যায় পাঞ্জাবীরা। এই তরুণীদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল মাত্র কয়েকদিন আগে। সম্ভবত: গোপন খবর পাঠিয়েছিল শত্রুদের কেউ। তরুণীদের চারজনই ছিল খুব সুন্দরী। এরা তিনজন ছিল চাচাত বোন। এদের বয়স ছিল পনের থেকে বিশের মধ্যে। এদের মশাখালি ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখে। পনের দিন পর ছেড়ে দেয়। সেনা ক্যাম্প থেকে বাড়ি ফিরে কয়েকদিনের ভেতরে তারা আত্মহত্যা করে। পরিবার তাদের ভালভাবে মেনে নেয়। কিন্তু তাদের এক কথা এ জীবন রেখে লাভ কি? এ মৃত্যু এলাকাবাসীকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে।

এই সব অনাচার, অত্যাচার, আতঙ্ক, কষ্টের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর আসে। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে বাংলাদেশ। আমার বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। আমার পরিবার মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছে।

লেখক : শিক্ষক