ঝালকাঠি প্রতিনিধি : গাবখান নদী থেকে কঁচা, সন্ধ্যা ও বলেশ্বর দামোদর  নদীর সংযোগে আন্তর্জাতিক নৌ-রুট হিসেবে গাবখান চ্যানেলের পরিচিতি । নাব্যতা হারিয়ে এখন গাবখান নৌ চ্যানেল মরা খালে পরিনত হয়েছে। ভারতের পশ্চিম বাংলার সাথে বাংলাদেশ এবং আসাম ও মেঘালয়ের নৌ-যোগাযোগের সহজতর ও গুরুতপূর্ণ এ গাবখান নৌ চ্যানেল । পিরোজপুরের সন্ধ্যা ও ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর সংযোগকারী ১৮ কিলোমিটার বিস্তৃত গাবখান চ্যানেল দেশের আন্তর্জাতিক নৌ-রুট হিসাবে প্রায় অর্ধ শতাব্দি  ধরে বাণিজ্য পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

অনিয়ন্ত্রিত নৌ ট্রাফিক সিগন্যাল, পাইলটবিহীন জাহাজ চলাচল আর ক্রমবর্ধমান চ্যানেল সংশ্লিষ্ট তিন নদীর নাব্যতা হ্রাসের কারণে এ রুটে নৌ যোগাযোগ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সংগত কারণে এ চ্যানেলে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল চুক্তির জাহাজ এবং ঢাকা-খুলনা-মংলা-চট্টগ্রাম রুটের যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ফলে নাব্যতায় বিপন্ন এ চ্যানেলটি এখন বন্ধের উপক্রম।

সরেজমিনে জানা গেছে, চ্যানেলের নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় জোয়ারের সময় এতে মাত্র ৭/৮ ফুট পানি থাকে। ভাটার সময় সাধারণ জাহাজ চ্যানেল অতিক্রম করতে পারে না। জোয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ঢাকা-খুলনা রুটের রকেট স্টিমার চলাচলের সময় চ্যানেলের বিপরীতগামী সকল জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। নদীর চরের পরিধি বৃদ্ধির কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

এলাকাবাসী জানায়, দুই বছর যাবৎ গাবখান চ্যানেলের দক্ষিণ দিকের প্রবেশ মুখে, চ্যানেলের পশ্চিম পাড়ে গাবখান সেতুর পিলার থেকে গাবখান বাজার পর্যন্ত এবং চ্যানেলের পশ্চিমে ধানঁসিড়ি নদীর প্রবেশ মুখে আশঙ্কাজনক ভাবে চর জেগে উঠছে। অবাঞ্চিত চর অপসারনে কিংবা নদী শাসনে ড্রেজিংয়ের কোন কার্যকর ব্যবস্থা না হওয়ায় এ সংকট র্আও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বাণিজ্যক পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ এ চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভাটার সময় সুগন্ধা,ধানসিঁড়ি, গাবখান ত্রিমোহনার ইকো পার্ক সংলগ্ন চরে জাহাজ, কার্গো আটকা পড়ে সেকারনে ঢাকা-খুলনা রুটের স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়।

জানা গেছে, ২০০৮ সালের ১৪ আগষ্ট উভয় দিক থেকে নৌ-চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। গভীরতা কমে যাওয়ায় ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে গাবখান নদীর বাঁক সিগনাল যথাযথভাবে মেনে একমুখী জলযান চলাচলের জন্য এ কর্তৃপক্ষ বিশেষ নদী বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এর জন্য ঢাকা-মংলা ও খুলনা নৌ-রুটের একমাত্র এই গাবখান চ্যনেলটিতে জাহাজ চলাচলের উপর বেশ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ জন্য কাউখালী স্টিমার ঘাট ও ঝালকাঠী স্টিমার ঘাটে নৌ ট্রাফিক সিগনাল রাখা হয়েছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি জাহাজ এবং কোস্টার কার্গো সবই নৌ ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে। কোন প্রান্ত থেকে চ্যানেলে একটি জাহাজ ঢুকলে অন্যপ্রান্ত থেকে ২-৩টি জাহাজ ঢোকে। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে এক বছরে নৌ ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্যকারী দু'শতাধিক জাহাজের বিরুদ্ধে কাউখালী থানায় জিডি করা হয়। পিরোজপুর জেলার কাউখালীর সন্ধ্যা নদীর মোহনা থেকে ঝালকাঠি জেলার বিষখালী-সুগন্ধা ও ধানসিঁড়ি নদীর মোহনা পর্যন্ত প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ চ্যানেল ১৮০০ সালের প্রথমে খনন করা হয়। তখন অবিভক্ত ভারতে এ অঞ্চলের সঙ্গে আসামের যোগাযোগ, ব্যবসা, বাণিজ্য এই চ্যানেলের উপরে নির্ভরশীল ছিল। চ্যানেল খনন করার জন্য তৎকালীন খাল খনন সংস্থা ১৫৮ দশমিক ৫০ একর জমি পিরোজপুরের কাউখালী, ঝালকাঠির শেখেরহাট ও গাবখান এলাকা থেকে অধিগ্রহণ করে। যা পর্যায়ক্রমিকভাবে ১৯৬৩ সালে ইপিআইডব্লিইটিএ'র কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। প্রথমে চ্যানেলের তত্ত্বাবধানকরত পানি ও বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (ওয়াপদা)। তখন চ্যানেলের প্রশস্ততা ছিল ৩০০ মিটার। তবে বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ১০০ মিটার এবং কোন কোন স্থানে এরও কম।

এ চ্যানেলবন্ধ হয়ে গেলে দেশের দু'টি সমুদ্র বন্দর মংলা ও চট্টগ্রাম সংযোগকারী নৌযানগুলোকে সুন্দরবন, বরগুনাসহ উপকুলীয় নৌ-রুটে হয়ে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ বেশি ঘুরতে হবে। চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গেলে সরকারি-বেসরকারি জাহাজ স্টিমার কার্গোসহ চলাচলকারী নৌযানগুলোর বাড়তি পথ ঘোরার কারণে তার পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে সেই সঙ্গে বেড়ে যাবে পণ্যসামগ্রীর দামও।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রতিদিন এই চ্যানেল দিয়ে নৌ-বাহিনীর জাহাজসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী জাহাজ, স্টিমার, কার্গো, কোস্টার, ট্যাঙ্কার চলাচল করে। যার মধ্যে ভারতীয় পণ্যবাহী নৌযানও রয়েছে। আর এসব নৌযানের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে তিনশ' কোটি টাকার পণ্য আমদানি রপ্তানি হয়। গাবখান চ্যানেলের প্রশস্তা হ্রাস পাওয়ায় দু'টি জাহাজের মুখোমুখি সংঘর্ষেও ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্যবার। আবার চ্যানেলের মাঝে মাঝে কিছু ডুবোচর সৃষ্টির ফলে চ্যানেলটি তার গতিপথ পরিবর্তন করে বহু ফসলি জমি ও বেড়িবাঁধ ধ্বংস করে ফেলেছে। গাবখান চ্যানেল এখন যে জন্য বন্ধ হাবার উপক্রম হয়েছে তা হলো ঝালকাঠির অংশের বিভিন্ন স্থানে চর জেগে নব্যতা হ্রাস পাওয়া এবং বিপজ্জনক বাঁকের সৃষ্টি হওয়া। পাশাপাশি পরিকল্পিত ড্রেজিং এবং সুষ্ঠু তদারকির অভাবে চ্যানেলটির নাব্যতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে গাবখান চ্যানেলটি ড্রেজিং করা প্রয়োজন।

(এএম/এএস/নভেম্বর ২৪, ২০১৪)