কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : চার সন্তানের মা হওয়ার পরও স্বামীর অধিকার আদায়ের জন্য এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হচ্ছে বৃদ্ধা সাজেদা বেগমকে (৫৫)। দু’মুঠো ভাতের জন্য তাকে এখন রাস্তার মটি কাটার কাজ, কখনও অন্যের বাসায় ঝি’র কাজ, হোগলা-কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু স্ত্রী ও সন্তানদের ফেলে রেখে স্কুল শিক্ষক স্বামী আবদুল হাই মৃধা অন্যত্র দ্বিতীয় বিয়ে করে বৃদ্ধা সাজেদাকে স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পর এখন তার মাথা গোঁজার শেষ সম্বল কুঁড়েঘরটিও কেড়ে নিয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের সলিমপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।

প্রায় তিন যুগ আগে উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ওমর আলী সিকদারের মেয়ে সাজেদা বেগমের সাথে একই এলাকার আহাম্মদ আলী মৃধার ছেলে আবদুল হাই মৃধার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাদের সংসারে আসে আলমগীর, খালেদা, মহসীন ও হামিদা চার সন্তান। পরিবারের অস্বচ্ছলতার কারণে সাজেদা বেগম নিজের নামের নয় কড়া জমি বিক্রি করে স্বামীকে লেখাপড়া করায়। লেখাপড়া শেষ করে যখন আবদুল হাই মৃধা চাকুরী নেয় তখনই পাল্টে যেতে থাকে। এ পর্যায়ে লালুয়া ইউসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকুরী নেয়ার পর সাজেদা বেগমকে না জানিয়ে লালুয়া ইউনিয়নের পারভীন বেগমকে বিয়ে করে সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যায়। তখন প্রথম স্ত্রীর কোলে ছোট মেয়ে আট মাসের হামিদা। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে এখন তার তিন সন্তান।

সাজেদা জানায়, ছোট বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পরই বাবা মারা যায়। স্বামীর সংসারে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চার সন্তানের মা। এরপরই স্বামী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় যৌতুকের দাবিতে তার উপর নির্মম নির্যাতন। কিন্তু যাওয়ার কোন জায়গা না থাকায় মারধর খেয়েও স্বামীর সংসারে জবুথবু হয়ে থাকতাম। কিন্তু লালুয়া স্কুলে চাকুরী হওয়ার পরই তার বদলে যাওয়া শুরু। এমনকি দুই মেয়ে হামিদা ও খালেদার বিয়ে দেয়া হলেও সে পিতার দায়িত্ব পালন করেনি। একজন শিক্ষকের ছেলে হয়েও আলমগীর ও মহসীন এখন দিনমজুরী করছে। টাকার অভাবে তাদের লেখাপড়াও শেখাতে পারেন নি।

সে জানায়, এখন যে ঘরে কোন রকম সন্তানদের নিয়ে মাথা গুঁজে ছিলেন, সেই বাড়িটিও বিক্রি করে চার সন্তান নিয়ে আমাদের পথে নামিয়ে দিয়েছে। একজন শিক্ষক এমন নির্দয় হয় কিভাবে ? স্বামী ও সন্তানের অধিকার নিয়ে তার কাছে গেলে নিজের সন্তান ও সাজেদার বিরুদ্ধে মামলা করে আবদুল হাই মৃধা।

কান্নাজড়িত কন্ঠে সাজেদা জানায় “ছোড মাইয়াডার সংসারেও আমার মতোন আগুন লাগছে। অর স্বামীও অরে মারধর কইর‌্যা ঘর থেইক্যা বাইর কইরা দেছে। বাপ নাই, আমি মরছি আমার জ্বালায়। মাইয়াডারে যে একটু দেখমু হেইয়ার ও উপায় নাই।” তার আর্তি“ এ্যাহন তো আর আমার স্বামীর সোহাগ দরকার নাই, আমি চাই শ্যাষ যে কয়ডা দিন বাঁচি স্বামীর ভিডায় যেন মরতে পারি। মোর পোলা মাইয়ারা যেন ভিডা হারা না হয়।”

জানাযায়, লালুয়া ইউসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বামীর নির্মম অত্যাচার ও বর্বরতা সহ্য করতে না পেরে ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি কলাপাড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট একটি মামলা করেন সাজেদা। সেই মামলায় আবদুল হাই মৃধা ও তার দ্বিতিয় স্ত্রী পারভীন বেগমকে আসামী করা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন আছে। মামলায় উল্লেখ করেন ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের দাবিতে গত ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ তাকে নিজ ঘরে বেধড়ক মারধর ও শ্বাসরোধকরে হত্যার চেষ্টা করা হয়।

এছাড়াও সাজেদা বেগমের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০৫ সালের ২৫ নভেম্বর মানবাধিকার সংঘঠন ব্লাষ্ট’র মধ্যস্ততায় কলাপাড়া থানায় স্কুলের শিক্ষক,জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের উপস্থিতিতে এক সালিশ হয়। সালিশে আঃ হাই মৃধা তার সকল দোষ স্বীকার করে নিলে সাজেদা বেগমকে প্রতিমাসে ১২’শ টাকা ও মাজেদা যে বাড়িতে অবস্থান করছেন সেই বাড়িটি তার নামে লিখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেই বাড়িটি গোপনে আ. হাই মাষ্টার তার দ্বিতীয় স্ত্রী পারভীন বেগমের নামে লিখে দিয়ে তা আবার বিক্রি করে দেয়।

এছাড়া গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সালে লালুয়া ইউসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম নীলগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে এক প্রতিবেদনে জানান, আবদুল হাই তার প্রথম স্ত্রীকে গত ১৫ বছরেও একবারও খোঁজ নেয়নি। তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সে এখন লালুয়াতে থাকছে। তার বেতন থেকে কিছু টাকা প্রথম স্ত্রীকে তারা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেও তার অনিচ্ছার কারনে তাও সম্ভব হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে আবদুল হাই মৃধা জানান, তিনি যা করেছেন ঠিকই করেছেন। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতিয় বিয়ে এবং তাকে ভরন পোষন দিচ্ছেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরা ভালো না। তাছাড়া আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আমি ভরন পোষন দেব কেন। তবে বাড়ি বিক্রির কথা স্বীকার করেন।

ইউসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, তারাও অনেক চেষ্টা করেছেন সাজেদা বেগম ও তার সন্তানরা যাতে ন্যায় বিচার পায়। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়েছেন।

(এমকেআর/এএস/নভেম্বর ২৪, ২০১৪)