চৌধুরী আ. হান্নান : হঠাৎ সেতু ভেঙ্গে যখন যানবাহনটি নদীতে পড়লো, তখন লোকে বুঝতে পারলো যে সেতুটি ধীরে ধীরে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল এবং সেতু রক্ষনাবেক্ষনে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল তারা দায়িত্বটা পালন করেনি। ব্যাংক ব্যবস্থায় যে ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতা চলছে তা বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। একজন সাধারণ সচেতন লোকই তা বলে দেবে।

বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করা গেছে পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের কেবল অদক্ষতার জন্য নয়, আর্থিক দুনীতির সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ দু’টি বড় সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। পরিষদের চেয়ারম্যান/ সদস্য যখন নিজ ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িত থাকেন তখন সে প্রতিষ্ঠান রক্ষা করবে কে ? শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এক সময়ের চেয়ারম্যান/পরিচালক মোহাম্মদ সোলায়মান নিজ ব্যাংকের ১৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে পুলিশ রিমান্ডে পর্যন্ত ছিলেন।

অতি সম্প্রতি খবরে জানা যায় ১৩০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি: এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ২৬ জন কর্মকর্তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনে তলব করা হয়েছে। বেসরকারী ন্যাশনাল ব্যাংকের ঢাকার ছয়টি শাখায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। (সমকাল, ৬ নভেম্বর)। ব্যাংকটিতে গত অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে যখন অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জেনারেল ম্যানেজারকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তখন আশংকা করা গিয়েছিল যে ন্যাশনাল ব্যাংকে ‘কিছু’ ঘটেছে। সে আশংকাই তো সত্য হলো। জানা যায়, ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শফিকুর রহমান পর্ষদের নিকট অপমান-অপদস্ত হয়ে পদত্যাগ করেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি অন্যায়-অনৈতিক নির্দেশনা পরিপালন করতে করতে চাননি।

এমনিভাবে যদি কাজী ফকরুল ইসলাম (বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি যিনি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অপসারিত হয়েছেন) পরিচালনা পরিষদের অনৈতিক নির্দেশনার প্রতিবাদে তাৎক্ষনিক পদত্যাগ করতেন তা হলে বেসিক ব্যাংকের বর্তমান দুরবস্থার দায়ভার তাকে বহন করে বেড়াতে হতো না।

জনাব শফিকুর রহমানের মত সৎ-সাহসী ব্যাংকারদের সুরক্ষা না দিলে, ব্যাংকে যোগ্য নেতৃত্ব উৎসাহিত হবে না। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার মাসুদ বিশ্বাসকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। আমরা ভুলিনি যে, বেসিক ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট, আত্মসাৎ ঠেকানো যায়নি।

পরিচালনা পরিষদ আর্থিক অনিয়ম/দুনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তেমন কিছু করার থাকে না। ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন অসহায় হয়ে পড়ে তখন বুঝতে হবে সর্বনাশটা আসছে। হলমার্ক কেলেংকারীর সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে অর্থমন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছিল।

আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন রাষ্ট্রমালিকানাধীন বানিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন-পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছেন (প্রথম আলো ২২ সেপ্টেম্বর )। ব্যর্থতার দায় স্বীকার করলেন কিন্তু পদত্যাগ করলেন না। সরকারের পক্ষ থেকেও ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধারের তেমন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে স্বপদে বহাল থাকা যায়, তা কেবল বাংলাদেশে সম্ভব হয়।

ব্যাংক ব্যবস্থা দ্রুত দুর্বৃত্তের কবলে চলে যাচ্ছে। লোপাট হয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থ ভান্ডার। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ইতিহাসের কলংক মোচন করতে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে রয়েছেন। তিনি যুদ্ধ শেষে বিজয়ী হয়ে একদিন ঘরে ফিরবেন। যখন দেখবেন ঘরের অর্থ লুট হয়ে গেছে, তখন তিনি কী করবেন ?

লেখক : সাবেক ব্যাংকার