আম্বিয়া অন্তরা, নিউইয়র্ক থেকে : বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করেও যারা দেশী সংস্কৃতির চর্চা করে চলেছেন তাদের মধ্যে নিউইয়র্কের বাঙালিরা অন্যতম। সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনে কোথাও না কোথাও বাঙালিদের নানা আয়োজন থাকেই। সেমিনার, কবিতা উৎসব, গানের আসর, বিনোদন ও শিক্ষামূলক নানা আয়োজনে থাকে বাঙালির প্রাণের ছোঁয়া। যার যেখানে মন চায় সে চলে যায় সেখানে।

এই সব নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালি কম্যুনিটির অনেকেই বাঙালি সংস্কৃতি-সভ্যতার প্রচার-প্রসারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। নিউইয়র্কে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েরা বাংলা বলতে পারে না। তাদেরকে গানের মাধ্যমে একদিকে বিনোদন, আরেকদিকে বাংলা ভাষা চর্চায় অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের যে কয়েকজন প্রবাসী তরুণ এই কাজগুলো নিরন্তর করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন অনুপ কুমার এষ । প্রচার বিমুখ এই তরুণ নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কম্যুনিটির অতি প্রিয় ও পরিচিত মুখ। সেই প্রিয়মুখ অনুপ কুমারের সঙ্গে কথা বলেছেন উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের বিশেষ প্রতিনিধি আম্বিয়া অন্তরা

অন্তরা : উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
অনুপ : আপনাকে ও আপনার মাধ্যমে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

অন্তরা : নিউইয়র্কের বাঙালি কম্যুনিটিতে আপনি খুবই প্রিয়মুখ। এই কম্যুনিটির জন্য আপনার নানা প্রয়াসের কথা বলুন।
অনুপ : আমি আমেরিকাতে আসার পর থেকেই নানা ভাবে বাঙালি কম্যুনিটির মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। ছোট বেলা থেকেই আমি অংক ও বিজ্ঞানে ভাল ছিলাম। এখানে এসে দেখেছি, আমাদের কম্যুনিটির বাচ্চারা অংক ও বিজ্ঞানে দুর্বল। এখানে এসেই আমার প্রথম টার্গেট হলো- ওদেরকে অংক ও বিজ্ঞানে সহযোগিতা করা। সেই সূত্র ধরেই আমি প্রাইমারি, মিডল, হাই স্কুল এবং স্কুল পরবর্তী প্রোগ্রামে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি। কলেজ লেভেলেও শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রোক্টরের দায়িত্ব পালন করেছি।
নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টেও পুলিশ অফিসার হিসেবে কাজ করেছি। সেই দায়িত্ব পালনের সময় আমি বিভিন্নভাবে বাঙালি কম্যুনিটির দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি। সেই সহযোগিতার ধরণটি ছিল এই রকম, জরুরি তথ্য দেওয়া, নানা বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা দেওয়া, অনুবাদের মাধ্যমে নিউইয়র্ক সিটির আইন-কানুন বুঝানো, নানা সহিংসতায় আক্রান্ত মানুষদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে সঠিক জায়গায় পাঠানো ইত্যাদি।
আরেকটি বিষয়, যা আমার যথেষ্ট মনঃকষ্টের কারণ ছিল তা হলো, নিউইয়র্কে বাঙালি কম্যুনিটির অনেক বাচ্চার বাংলায় কথা বলতে না পারা। তখন আমি সঙ্গীতকে বেছে নিলাম ওদেরকে বাংলা শেখানোর কাজে। বাংলা গানের মাধ্যমে আমি ওদের অনেককেই বাংলা শেখার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছি। ঈদ, পুজা, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, মহান একুশের নানা আয়োজন ছাড়াও সামাজিক পুনর্মিলনি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। কখনো গানে, কখনো বাজনায়, কখনো মনোমুগ্ধকর শব্দ যন্ত্র দিয়ে আমাদের কম্যুনিটির সেবা করেছি এবং করে যাচ্ছি সফল ভাবেই।

অন্তরা : নিউইয়র্কে আমাদের কম্যুনিটিতে বাঙালি সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য নতুন প্রজন্মের হয়ে আপনি কতটুকু সফল হয়েছেন বলে মনে করেন ?
অনুপ : কী বোর্ড থেকে গিটার ; জনপ্রিয় বাংলা গানগুলো যখন আমার গিটারের তারে বেজে ওঠে, তখন বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে আমেরিকাতে জন্ম নেওয়া ছেলে মেয়েরাও পুলকিত ও আগ্রহী হয়ে ওঠে। এসে জিজ্ঞেস করে, এই সব গান কিভাবে বাজানো শেখা যায় ? আর এই ভাবেই নতুন প্রজন্ম আগ্রহী হয়ে উঠছে বাংলা গানের প্রতি। সংখ্যায় সেটা অল্প হলেও প্রবাসে সেটা আমাদের দেশী সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখছে বলেই আমি বিশ্বাস করি।
শুধু বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ছেলে মেয়েরাই নয়, বিদেশীরাও আমার গিটারে বাজানো বাংলা গানের সুর-মূর্ছনায় মুগ্ধ হচ্ছে, ঝুঁকছে বাংলা গানের প্রতি। যে গিটারে আমেরিকান কান্ট্রি মিউজিক বাজে, সেই গিটারে বাংলা গান শুনে বিদেশীরাও বিমোহিত।
সবচেয়ে বড় কথা, আমি কাজ করি। আমার সাফল্য-ব্যর্থতার ভার নিউইয়র্কের বাঙালি কম্যুনিটির।

অন্তরা : প্রবাসে বাঙালি সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য কি কি করনীয় বলে আপনি মনে করেন ?
অনুপ : প্রবাসে বাংলাদেশী তথা বাঙালি সংস্কৃতি ধরে রাখতে হলে অবশ্যই আমাদের কম্যুনিটির নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদেরকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। শুধু বাংলা ভাষা শিখলেই সাফল্য আসবে না। যদি ওদেরকে বাংলা নাচ-গানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তাহলেই খুলবে সাফল্যের দরজা। এতে ওরা আগ্রহ নিয়ে বাংলা গানগুলো শুনবে, গানের কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করবে। আর এটাই প্রবাসে বাঙালি সংস্কৃতি ধরে রাখার উপায়।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে প্রবাসের সকল পিতা-মাতাকে অনুপ্রাণিত করি, তারা যেন লেখাপড়া ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার দরজাটি খুলে রাখেন।

অন্তরা : নিউইয়র্কের বাঙালি কম্যুনিটির নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনি কি ধারণা দেন ?
অনুপ : আমি নতুন প্রজন্মকে বলি, মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের ফসল বাংলাদেশ; খুবই সুন্দর একটি দেশ। বাংলাদেশের সম্ভাবনাও অপার। বাংলা ভাষা পৃথিবীর একমাত্র ভাষা, যার জন্য মানুষ জীবন বিসর্জন দিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাঙালি অতিথি পরায়ণ জাতি। নাচ, গান কবিতা আর আড্ডা বাঙালির প্রাণ। হৃদয়ে ধারণ কর বাংলাদেশ।

অন্তরা : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অনুপ : ধন্যবাদ আপনাকেও। ধন্যবাদ আপনার ও উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের মাধ্যমে সকল বাংলাভাষীকে।

(অ/নভেম্বর ২৭, ২০১৪)