বাগেরহাট প্রতিনিধি :বাগেরহাটের সাদাসোনা খ্যাত বাগদা চিংড়ির দাম বাজারে অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় চিংড়ি চাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম কেজিতে চার থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

একদিকে বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম কমে গেছে অন্যদিকে চাষীদের ডিপো মালিকদের কাছে চিংড়ি বাকিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। ডিপো মালিকরা চাষীদের কাছ থেকে বাকিতে চিংড়ি কেনার কথা স্বীকার করেছে। ফলে এই চিংড়ির উপর নির্ভরশীল হাজার হাজার চাষী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। তবে বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) দাবী করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম ও চাহিদা কমে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কবে নাগাদ চিংড়ির বাজার স্বাভাবিক হবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদিন চিংড়ির দাম ওঠানামার বিষয়টি তদারকি করতে চাষীরা মৎস্য বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সরকার যদি এখনই এই চিংড়ি শিল্পে জড়িত চাষীদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয় তাহলে এই শিল্প থেকে তারা সরে আসতে পারে বলে চিংড়ি চাষী সমিতি আশংকা প্রকাশ করেছে। বাগেরহাটের চিংড়ি বেচাকেনার অন্যতম বারাকপুর মৎস্য আড়ৎতের ডিপো মালিক ও চাষীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গত তিন মাস ধরে বাগদা চিংড়ির এই অবস্থা চলছে।

চলতি মৌসুমে বাগদা চিংড়ির বাজার দর (বর্তমানে ১৫ গ্রেড ৮০০ টাকা, যা তিন মাস আগে ছিল ১৩০০ টাকা), ২০ গ্রেড ৭০০ টাকা যা আগে ছিল ১১০০ টাকা, ৩০ গ্রেড ৬০০ টাকা যা আগে ছিল ৮৫০ টাকা, ৪৪ গ্রেড ৪০০ টাকা যা আগে ছিল ৬০০ টাকা এবং ৬৬ গ্রেড ২০০ টাকা যা আগে ছিল ৪৫০ টাকা)।

বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকপুর মৎস্য আড়তে বাগদা চিংড়ি বিক্রি করতে আসা বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার উজলকুড় ইউনিয়নের বড় দূর্গাপুর গ্রামের চিংড়ি চাষী দিপঙ্কর বাড়ৈ বলেন, চলতি মৌসুমে আমি তের বিঘা জমিতে বাগদা চিংড়ির চাষ করেছি। মৌসুমের শুরুতে ঘেরে যে রেণু পোনা ছেড়েছিলাম তা ভাইরাস সংক্রমিত ছিল। পরে আবার নতুন করে পোনা ছাড়ি। সেই পোনায় বাগদা চিংড়ির উৎপাদন ভালই হয়েছে। প্রথম দিকে বাগদা চিংড়ি বারোশ টাকা পর্যন্ত কেজি বিক্রি করেছি। সেই চিংড়ি এখন ৬ থেকে ৭শ টাকায় বিক্রি করছি তা আবার বাকিতে। ডিপো মালিকের কাছে বর্তমানে আমার লক্ষাধিক টাকা পাওনা রয়েছে। এই টাকা কবে নাগাদ দিতে পারবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদিন চিংড়ির দাম ওঠানামার বিষয়টি তদারকি করতে তিনি মৎস্য বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রামের চিংড়ি চাষী আব্দুস সাত্তার বলেন, এবছর আমি কুড়ি বিঘা জমিতে বাগদা চিংড়ির চাষ করেছি। মৌসুমের শুরুতে বাগদা চিংড়ি নগদ টাকায় ভাল দাম পেয়েছি। গত তিন মাস ধরে বাগদা চিংড়ির দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। বারাকপুর মৎস্য আড়ৎ এর শাহ জালাল মৎস্য আড়ৎ নামের একটি ডিপোতে শুরু থেকে চিংড়ি বিক্রি করে আসছি। গত তিন মাসে ওই ডিপো মালিকের কাছে বর্তমানে আমার প্রায় তিন লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এই টাকা কবে নাগাদ পাব তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আন্তজার্তিক বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম কমে যাওয়ায় নতুন করে কোন শিপমেন্ট না থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে ডিপো মালিক তাকে জানিয়েছে। চিংড়ি শিল্পকে রক্ষা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

বারাকপুর মৎস্য আড়ৎ এর শাহ জালাল আড়ৎ এর ডিপো মালিক ইউসুফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসাসিয়েশন (বিএফএফইএ) দাবী করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম ও চাহিদা কমে যাওয়ায় বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম কমে গেছে। গত সেপ্টম্বর থেকে নতুন করে কোন শিপ মেন্ট হচ্ছেনা। গত তিন মাসে আমি চাষীদের কাছ থেকে ত্রিশ লাখ টাকার চিংড়ি বাকিতে কিনেছি। আমি যেমন চাষীদের কাছ থেকে বাকিতে চিংড়ি কিনেছি তেমনি আমিও এজেন্টের কাছে বাকিকে চিংড়ি বিক্রি করেছি। তারা আমার পাওনা টাকা দিলে আমিও চাষীদের পাওনা দিয়ে দেব।

বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষী সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম বলেন, চিংড়ি উৎপাদনে দেশের অন্যতম জেলা বাগেরহাট। এই জেলার শতকরা সত্তর ভাগ মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত। মৌসুমের শুরুতে চিংড়ি ঘেরে ভাইরাস সংক্রমিত হয়। ঘের মালিকরা ভাইরাসের প্রকোপ কাটিয়ে উঠে ঘেরে চিংড়ির উৎপাদন ভাল পায়। ঘেরে উৎপাদিত চিংড়ি মৌসুমের প্রথম দিকে বাজারে দামও পায় আশানুরুপ। কিন্তু তিন মাস আগে হঠাৎ করে বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম অস্বাভাবিকহারে কমে যায়। গত তিন মাস আগে চাষীরা যে চিংড়ি ১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছে তা এখন ৬ থেকে সাতশ টাকায় বিক্রি করছে। কেজি প্রতি চার থেকে পাঁচশ টাকা কম। একদিকে চিংড়ির দাম কম অন্যদিকে তা আবার ডিপো মালিকদের কাছে বাকি রাখতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই জেলার চাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থার নিরসন করা না গেলে চাষীরা চিংড়ির চাষের উপর আগ্রহ হারাবে। তাই তিনি সরকারকে বাইরের নতুন নতুন চিংড়ির বাজার সৃষ্টি করার দাবী জানিয়েছেন।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য বিভাগের বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র মন্ডল বাগদা চিংড়ির দাম কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করে এই প্রতিবেদককে বলেন, হিসেব অনুযায়ী এ বছর জেলার নয়টি উপজেলায় মোট সত্তর হাজার হেক্টর জমিতে বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাষ হয়েছে। এরমধ্যে ৪৭ হাজার হেক্টর জমিতে মোট ৩৯ হাজার ঘেরে বাগদা চিংড়ির চাষ করা হয়েছে। জেলায় বাগদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন। মৌসুমের শুরুতে কিছুটা সমস্যা ছিল। এবছর বাগদা উৎপাদন ভাল। বাগদা ও গলদা চিংড়ি উৎপাদনে দেশের অন্যতম জেলা বাগেরহাট। প্রথম দিকে চাষীরা মাছের দামও ভাল পেয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে চিংড়ির বাজার দর পড়ে যাওয়ায় চাষীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তবে কি কারনে বাজার দর পড়ে গেছে তা বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসাসিয়েশন (বিএফএফইএ) ভাল বলতে পারবে। এই বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই বলে তিনি দাবী করেন।

বাগেরহাট বারাকপুর মৎস্য আড়ৎদার সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, বারাকপুর মৎস্য আড়ৎ এ চিংড়ি বেচাকেনার কুড়িটি ডিপো রয়েছে। গত তিন মাসে এই সব ডিপো মালিক চাষীদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা চিংড়ি বাকিতে কিনেছে। বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসাসিয়েশন (বিএফএফইএ) আন্তজার্তিক বাজারে বাগদা চিংড়ির বাজার দর ও চাহিদা কমে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এজেন্টরা জানিয়েছে। তাই এই চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।



(এমএম/এসসি/ডিসেম্বর০৬,২০১৪)