বাগেরহাট প্রতিনিধি : সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল এখন ‘থালা-বাসন, ফোম ও কলা পাতা’ দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে অপসারণের কাজ শুত্রুবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে। সুন্দরবন সন্নিহিত লোকালয়ের মানুষ ও জেলে-বনজীবীরা এভাবেই শ্যালা নদীসহ খাল থেকে তেল অপসারনের  কাজ শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার বিকালে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন সংলগ্ন লোকালয়ে মাইকিং করে ভাসমান তেল তুলে নেয়ার আহবান জানানো হয়। সকাল থেকে শুরু হয় তোড়জোড়। তারা তেল সংগ্রহের  পর পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে লিটার প্রতি ৩০ টাকা দরে বিক্রি করছে। পদ্মা অয়েল কোম্পানি সুন্দরবন থেকে এর আগে তেল কেনার ঘোষণা দিলে এগিয়ে সাধারন মানুষ। ভাসমান তেল সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া রোধে ও তেল তোলার সুবিধার্থে জোয়ারের সময় খালগুলোতে ফার্নেস অয়েল যাতে বের হতে না পারে সে জন্য বৃহস্পতিবারই খালগুলোর মুখে নেট দিয়ে ব্যরিকেট দেয়া হয়। এদিকে শুক্রবার দুপুরে শ্যালা নদীর চরে একটি গুইসাপসহ অসংখ্য জলজ প্রানী মরে থাকতে দেখা গেছে। সুন্দরবনের ভাসমান তেল আপসারনে রাসায়নিক ক্যমিকেল ফোম ব্যাবহার করবে না। রাসায়নিক ক্যমিকেল ফোম ব্যাবহার করলে ডলফিনসহ জলজ প্রানী ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে আরো অনেক বেশী ক্ষতির সম্মুখিন হবে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন । সুন্দরবনের এ তেল ছড়িয়ে পড়েছে মংলার চিংড়ি খামার থেকে বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে বয়া পর্যন্ত। গত  চারদিনেও ট্যাংকারের মাস্টার মোকলেসুর রহমান (৫০) নিখোঁজ রয়েছেন।

বিাআইডাবলুটিএর জাহাজ কাণ্ডারি-১০ এসে পৌঁছালেও সেটি কখন থেকে রাসায়নিক ছিটানোর কাজ শুরুর জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে।এব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মু.শুকুর আলী। আপাতত ডিসপারসেন্ট ফোম কেমিক্যাল ছিটানোর কাজ বন্ধ রয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান মো. শামসুদ্দোহা খন্দকার জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তিন দিন বন সংলগ্ন লোকালয়ের মানুষের সহায়তা নিয়েই তেল সংগ্রহের চেষ্টা করা হবে। পরে রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এবিষয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, কোন অবস্থায়ই সুন্দরবনের ভাসমান তেল আপসারনে রাসায়নিক ক্যমিকেল ফোম ব্যাবহার করা হবেনা। রাসায়নিক ক্যমিকেল ফোম ব্যাবহার করলে ডলফিনসহ জলজ প্রানী ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে আরো অনেক বেশী ক্ষতির সম্মুখিন হবে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। পরিবেশ ও বন মত্রনালয় এবিষয়টিকে গুরুতের সাথে দেখছে। এদিকে, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারর্বার মাস্টার কে এম আকতারুজ্জামান জানান, ডুবে যাওয়া ট্যাংকারে ছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল। জাহাজ কা-ারিতে মাত্র ১০ হাজার লিটার তেলের তেজস্ক্রিয়তা কমানোর মতো রাসায়নিক রয়েছে।

বন বিশেষজ্ঞদের মতে তেলের কারনে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির স্বীকার হতে পারে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। আর জোয়ার ভাটার প্রভাবে ফার্নেস ওয়েল পানিতে দ্রবিভুত অক্সিজেন হ্রাস পেয়ে সেখানকার জ্বলজ প্রানীর জীবনকে সংকাটপূর্ন করে তুলেছে। এছাড়া নদী তীরবর্তী এলাকায় গুল্ম ও উদ্ধিদের শ্বাসমুল ভারী ফার্নেস অয়েলে জড়িয়ে যাচ্ছে। যদিও ঠিক এ মুহুতেই উদ্ভিদ জৎগতের ক্ষতির বিষয়টি ছোখে পড়বে না। তবে ১৫/২০ দিনের পর গুল্ম গুচ্ছ ও উদ্ভিদদের রং বিবর্ণ হয়ে মারা যেতে পারে বলে তাদের রয়েছে উদ্বিগ্নতা। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড: শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন,সুন্দরবনের ব্যাপক এলাকা জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়ায় পানিতে দ্রবিভুত অক্সিজেন স্বাভাবিক ভাবেই কমে গেছে। এ কারনে ডলফিনসহ অন্য প্রানীকুলে ক্ষতিতে পড়তে বাধ্য । উদ্ভুত পরিস্তিতিতে সেখানকার নদীতে থাকা ডলফিন যদি অনত্র্য সরে গিয়ে থাকতে পারে তবে এ ধরনের থ্রেট থেকে নিজেরাই তাদের রক্ষার করতে সক্ষম হবে । তা না হলে বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতিসহ ৬ প্রজাতির অভয়াশ্রম ধ্বংস হয়ে যাবে। আমারা হারাবে এ ৬ প্রজাতির ডলফিন। যা ছিলো আমাদের সম্পদ। এ তেলের কারনে সুন্দরবনের জ্বলজ প্রানী উদ্ভিদের দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির মধ্যে পড়বে। শুক্রবার শ্যালা নদীর চরে একটি গুইসাপসহ অসংখ্য জলজ প্রানী মরে থাকতে দেখা গেছে । এথেকেই বোঝা যায় এই তেল দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব ফেলবে সুন্দরবনে। ম্যানগ্রোভ গাছের কি পরিমান ক্ষতি হবে তা দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই বোঝা যাবে। এদিকে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির বাগেরহাট জেলা শাখা সদস্য সচিব ফররুক হাসান জুলেয় তাদের জাতীয় কমিটির বরাত দিয়ে জানান সরকার আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন সম্পর্কে নিলিপ্ত আচরন করছেন আর এই দূর্ঘটনা বলে দেয় সুন্দরবন কতটা অরক্ষিত। তিনি আরও বলেন এই সুন্দরবনের পাশে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান করা হলে সুন্দরবনের জন্য কতটা ঝুকিপূর্ন হবে তা বলাই বাহুল্য। সরকারের এ হটকারী সিদ্ধানের ফলে বনটি একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে। ওই তেল পানিতে ছড়িয়ে পড়ায় মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বিশেষ করে জোয়ারে তেলযুক্ত পানি বনে প্রবেশ করায় গাছের গোড়ায় ও শ্বাসমূলে তেলের আবরণ লেগে যাওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। পানিতে বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতি ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন ও ৩শ’ প্রজাতির মৎস্য সম্পদসহ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ ক্ষয়-ক্ষতি নিরুপনে বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে গঠিত ৯ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থল সুন্দরবন পরির্দশন করেছেন। পরিদর্শন কালে তদন্ত কমিটির কোন সদস্য সাংবাদিকদের কাছে মতামত ব্যাক্ত করেনি। এই কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মন্ত্রনালয়ে তাদের রিপোর্ট পেশ করবে। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীর চাঁদপাই রেঞ্জের মালবাহী ট্যাংকার জাহাজের ধাক্কায় ‘ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামে একটি তেলবাহী ট্যাংকার মঙ্গলবার ভোরে ডুবে যায়। ট্যাংকারটি গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৮ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাচ্ছিল।

(একে/পি/ডিসেম্বর ১২, ২০১৪)