সুবল চন্দ্র সাহা : ডিসেম্বর মাস। মহান বিজয় দিবসের মাস। এ মাসের ১৬ তারিখে প্রিয় মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হয়। অর্জিত হয় দীর্ঘকালের আকাংখিত স্বপ্ন নিয়ে ঘেরা জাতীয় মুক্তি তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে হাজার বছর পরে প্রথম বাঙালী রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে। তবে এ বিজয় অনায়াসে এবং আপোষের ভিত্তিতে আসেনি, আসেনি পরাশক্তির আলোচনায় নিষ্কন্টকে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের সীমাহীন আত্মত্যাগ ও চারলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা বাঙালীর শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এ বিজয় একাধারে যেমন চরমতম আনন্দ ও উল্লাসের, তেমনি বেদনাবিধূরও বটে।

ইতিহাসের নিরিখে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ বিজয় কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। নয় মাসের যুদ্ধের মধ্যেই এর ব্যাপ্তি সীমাবদ্ধ নয়। এ বিজয়ের দীর্ঘ পটভূমি রয়েছে, রয়েছে হাজার বছরের মুক্তি সংগ্রামের এক অনন্য ইতিহাস। বিট্রিশের পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ দিন স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে হয়েছিল। অবশেষে ১৯৪৭ সনে এ উপমহাদেশে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তান ও ভারত। মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান। ২০০০ মাইল ব্যবধানের দু’টি ভিন্ন সংস্কৃতির ভূ-খণ্ড নিয়ে গড়ে তোলা পাকিস্তানের ভিত্তি ছিল ধর্ম। ফলে উভয় অঞ্চলের জনগনের ভেতর ক্রমাগত ধর্মীয় উন্মদনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। হিংসা, বিদ্বেষ ও জাতিগত দ্বন্ধে ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। রাষ্ট্র গঠিত হয় জাতি ভিত্তিক, ধর্ম ভিত্তিক নয়। কারন ধর্ম জাতীয়তার একটি উপাদান মাত্র। আর জাতীয়তার অন্যতম প্রধান উপাদান হল মানুষের সংস্কৃতি। সঙ্গঁত কারনেই পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়াতেই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি বাঙালীর কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাংঘর্ষিক ছিল। তবে শত চেষ্টা করেও পাকিস্তান বাঙালীর সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, পারেনি বাঙালীর অগ্রযাত্রার পথকে ব্যাহত করতে।

১৯৪৮ সনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এ অনুষ্ঠানে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষনা দেন। বাঙালীর সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতালাভের মোহভঙ্গ ঘটে। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ছাত্র-জনতা বিক্ষোপে ফেটে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র জনতার নেতৃত্ব দেন। ১১ই মার্চ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কারাবরণ যেন তাঁর জীবনে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনের সময় মাতৃভাষার দাবীতে জেল খানায় অনশন শুরু করেন। ২ বছর কারাবরনের পর বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। ষাটের দশকে বাঙালী জাতির শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখর এক নেতা হিসেবে আর্বিভূত হন। ১৯৬৬ সনে তিনি বাঙালীর মুক্তিসনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। বাঙালী জাতির আত্ম নিয়ন্ত্রনের অধিকারের দাবিতে দেশব্যাপী এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করেন। প্রচণ্ড গণআন্দোলনের মুখে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খাঁন পদত্যাগ করেন। ১৯৬৯ সনে ইয়াহিয়া খাঁন পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। পূর্ব বাঙালার আপামর জনগন পাকিস্তানী শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে ক্রোধে ফেটে পড়ে। ১৯৭০ সনে গণরোষ প্রশমিত করতে ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে। কিন্তু তাল বাহানা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ইয়াহিয়া খাঁন ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ সভায় উপস্থিত হয়। জনসমুদ্রের উপস্থিতিতে তিনি উদাত্ত আহবান জানিয়ে ঘোষণা করেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। তিনি আরও বলেন যার যা কিছু আছে তা নিয়া শত্রুর মোকাবেলা কর।

১৯৬৩ সনের ১৯ নভেম্বর আব্রাহিম লিংকনের গ্যের্টিসবার্গ এ্যাড্রেসটি যেমন ছিল আমেরিকার স্বাধীনতার মূলভিত্তি। তেমনি ১৯৭১ সনের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল বাঙালী জাতীর ঐক্যের দার্শনিক ভিত্তি। অত:পর ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের জান্তা অতর্কিতে বাঙালী ওপর সশস্ত্র আক্রমন চালায়। নিরীহ জনগণকে নির্মম ভাবে হত্যা করতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ গ্রেফতার হবার পূর্বক্ষণে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ের ১৩ দিন চূড়ান্তরূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৭১ সনের ডিসেম্বর ৩ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার প্যারেড ব্রিগেডে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমি এ দিন জনসভায় উপস্থিত ছিলাম। সভা চলাকালীন কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় একটি চিরকুট শ্রীমতি ইন্দরা গান্ধীর হাতে দিলেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দ্রুত ভাষণ শেষ করে সভা স্থল ত্যাগ করেন। জানা গেল পাকিস্তান বিমান বাহিনী পশ্চিম ভারতের বিমান ঘাটীগুলোর ওপর বিনা উস্কানিতে আক্রমণ চালিয়েছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঐ দিন সন্ধ্যায় দিল্লি ফিরে যান। রাত ১০:৩০মিনিটে মন্ত্রী সভার জরুরী বৈঠক আহবান করেন। সর্বসম্মতি সিন্ধান্ত অনুযায়ী ভারত পালটা আক্রমন শুরু করে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সারা ভারতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। রাত ১২:২০মিনিটে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দেশবাসীর উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন। ভাষণে বলেন বাংলাদেশের অসীম শৌর্যবান মুক্তিযোদ্ধারা জীবনকে বাজী রেখে যুদ্ধ করে যাচ্ছে দেশ প্রেমের উন্মদনায়। আমরা তাদের সম্মান করি। আজ এই যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধ হিসেবেও অত্মপ্রকাশ করল। পরদিন অর্থাৎ ডিসেম্বর ৪ তারিখ বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্দের যৌথ স্বাক্ষরে ভারতের প্রধান মন্ত্রীর নিকট বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দানের জন্য আবেদন করেন। ভারত সরকার ডিসেম্বর ৬ তারিখে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেন। ৯মাস সশ্রস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের শেষে ডিসেম্বর ১৬ তারিখ বিকেলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সেনাপতি ও ৯৩ হাজার সামরিক জান্তা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে অবনতমস্তকে আত্মসমর্পন করে।

রক্তাত্ত্ব মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির মুক্তিদূত। বাঙালীর হৃদয়ে তিনি চির ভাস্কর হয়ে আছেন। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্ট মানুষ নামধারী পাষন্ড পিচাশেরা তাঁকে সপরিবারে হত্যা করলেও তাঁর নাম নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। তিনি মরেও অমর হয়ে রয়েছেন বাঙালীর মনিকোঠায়। বাঙালীর কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতিই ছিল তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। যতই দিন যাবে বাঙালী সংস্কৃতি তাঁকে সহস্রাব্ধ থেকে সহস্রাব্ধ পর্যন্ত চির অম্লান করে রাখবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মা তখননি শান্তি পাবে যদি আমরা তাঁর আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারি।

আমাবস্যার ঘুট ঘুটে অন্ধকার দেখে ভয়পাবার কিছু নেই; যামিনী অবসানে আলোকাজ্জ্বল সূর্য উদিত হবেই। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির দম্ভোক্তি ও আস্ফালন, শুভ শক্তির কাছে পরাভূত হবে সুনিশ্চিত। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙ্গালীর নেতা ছিলেন না, বিশ্বের নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী, মহামতি লেলিন, হো-চো-মিন, মাও সেতুং, কামাল আর্তাতুক, জোসেফ টিটো, ফিদেল কেষ্ট্রো, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্ধিরা গান্ধী প্রমুখ বিশ্বের মুক্তিকামী নেতৃবৃন্দের ন্যায় বিশ্বের শোষিত মানুষের সংগ্রামী নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর চিরস্মরনীয় হয়ে রয়েছেন। আসুন তাঁর আমৃত্যু লালিত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সার্থক করে তুলতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হই। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসুরি গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ রূপায়ন করব, এই হোক আজকের মহান বিজয় দিবসের অঙ্গীকার। জয়তু বাংলাদেশ, জয়তু বঙ্গবন্ধু।


লেখক : আইনজীবি ও সিনিয়র সহ-সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগ, ফরিদপুর।