গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি : এহোনও হামার পিটাই। তা না হলি আর পেটে ভাত যায়না। চৌইলতে কষ্ট হয়। মাঝে মধ্যি নিজেরে সামাল দিতি পারিনা। জীবনে তো কিচ্ছুই ওলো না। বয়াসতো সত্তুর হইলো। মাইয়াডারে বিয়ে দিছি। তিনডা ছোয়াল। যার যার মতোন সোংসার চালায়। আমাগো খোজ কেউ রাহেনা। বউডা অসুখে ঘরে পড়া। দিনে চল্লিশ পুঞ্চাশ টাহার ওষুধ লাহে। তাই হামার ছাড়তে পারি না। গায়ে খাইটা খেতে হয়। দুঃখ ভারাক্রান্ত কন্ঠে এসব কথা বলেন মুক্তিযোদ্ধা গোপাল চন্দ্র কর্মকার।

পাক সেনাদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেনে, নিজ বাড়িতে বাঙ্কার করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংরক্ষন, বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ সরবরাহ, গ্রেনেড ফাটিয়ে পাক সেনাদের হত্যা করেছেন, কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হলোও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনও স্বীকৃতি পাননি মুক্তিযোদ্ধা গোপাল চন্দ্র কর্মকার। এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার বটের বাগান গ্রামে।

এক প্রশ্নের জবাবে গোপাল চন্দ্র কর্মকার বলেন, সরকার যখন ভাতা দেয়া শুরু করে তখন আমার ছোয়ালরা কার্ড করার চেষ্টা করছিল। তখন কার্ড করতে অনেক টাকা খরচ হবে বলে আর কার্ড করিনি। আমি যে আয় করি তা দিয়ে পেট চালানো কষ্ট। এই কারনে আর যোগাযোগ করিনি।

ভূমিহীন, নিঃস্ব এই মুক্তিযোদ্ধা জেলা শহরের কামার পট্রির ছোট্র একটি ভাড়া দোকান ঘরে বড় ছেলে কালাচাঁনকে নিয়ে কামারের কাজ করেন। যা আয় হয় বাবা ও ছেলে অর্ধেক ভাগাভাগি করে নেন। ছেলেরা তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকে। আর এই মুক্তিযোদ্ধা ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত স্ত্রী বেলা রানী কর্মকারকে (৬০) নিয়ে ওই দোকানেই বসবাস করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যিনি গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়ায় পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে গ্রেনেড হামলা, ক্যাম্প দখল করে অস্ত্র লুট, মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ সরবরাহ করে দেশ মাতৃকার যুদ্ধে জয়ী হলেও জীবন যুদ্ধে তিনি পরাজিত এক যোদ্ধা। জীবনের পড়ন্ত বয়সে স্থান হয়েছে গোপালগঞ্জ জেলা শহরের পাচুঁড়িয়ার পৌর মার্কেটের কামার পট্রির একটি ভাড়া ঘরে।

মুক্তিযোদ্ধা গোপাল চন্দ্র কর্মকার বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর হেমায়েত উদ্দিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোটালীপাড়ার টুপুরিয়ায় চলে আসেন। আমাদের ৪০/ ৪৫জনকে নিয়ে প্রথমে নারিকেল বাড়ি গ্রামে (বর্তমানে যেখানে হাই স্কুল সেখানে) মিটিং করেন। মিটিং-এ হেমায়েত ভাইয়ের নেতৃত্বে দল গঠন করা হয়। হেমায়েত উদ্দিনের নির্দেশে কোটালীপাড়া থানার অস্ত্রাগার লুট করে সেই অস্ত্র ও গুলি নিয়ে, আমরা কোটালীপাড়ার ঘাঘরের পশ্চিমপাড় গ্রামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে বেশ কিছু পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। হরিনাহাটি নদীতে পাকিস্তানী বাহিনীর গান বোডে হামলা হয়। পাক সেনাদের পাল্টা হামলায় হেমায়েত উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। তখন তাকে নৌকায় করে কোটালীপাড়ার পশ্চিমপাড়ে ডাক্তার লৎফর রহমানের বাড়িতে নিয়ে যাই। এই দুইটি যুদ্ধে আমি ছিলাম। এর পর থেকে আমাকে দিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আনা নেয়ার কাজ করানো হতো। এসব অকপটে স্বীকার করেলেন বাহিনী প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রমও।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হেমায়েত বাহিনীর ছিলো ৫২ টি কোম্পানী। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, মাদারীপুর, বরিশাল, বাগেরহাট ও যশোরের অংশ বিশেষে সম্মুখ যুদ্ধ করেছে হেমায়েত বাহিনীর যোদ্ধারা। হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রমের সাথে সার্বক্ষণিক থাকতেন তিনি। গোপাল চন্দ্র কর্মকারের বাড়িতে ছিলো হেমায়েত বাহিনীর অস্ত্রাগার। জীবন বাজি রেখে হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারী অস্ত্র, গুলি ও গ্রেনেড পৌঁছে দিতেন তিনি। পয়সারহাট নদী থেকে কাদেরিয়া বাহিনী (বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর )কাছ থেকে অস্ত্র বহন করে হেমায়েত বাহিনীর অস্ত্রাগারে নিয়ে জমা রাখতেন এবং হেমায়েত উদ্দিনের নির্দেশ মোতাবেক অস্ত্র পৌছে দিতেন। তখন তিনি ২৭ বছর বয়সী এই অকুতভয় বীর।
নিজ জীবন বাজি রেখে সাহসী এই যোদ্ধা গোপালগঞ্জ জেলা সদরের (বর্তমান উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন) পাকহানাদার বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। এখান থেকে তারা বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করতো। পাক বাহিনীকে ওই স্থান থেকে হটাতে নিজে লুঙ্গি পড়ে খালি গায়ে ঝাকায় কলা বিক্রি করতে আসেন মুক্তিযোদ্ধা গোপাল চন্দ্র কর্মকার। লুঙ্গির নিজে নিয়ে আসেন পাতা রং এর একটি গ্রেনেড। কলা বিক্রির পর বিশ্রামের ভান করে সময় কাটান এবং কৌশলে গ্রেনেডের চাবি খুলে গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে বেড়িয়ে পরেন। এই গ্রেনেড হামলায় বেশ কিছু পাক সেনা নিহত হয় বলে মুক্তিযোদ্ধা গোপাল চন্দ্র কর্মকার এই প্রতিবেদকে জানান। এই বিষয়টিও স্বিকার করলেন হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রম।
তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিলো ২৭বছর। বাবার নাম চৌতন্য সুধিন কর্মকার। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বেলা রানী কর্মক রের সাথে বিয়ে হয়। আমাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে ঝর্ণা রানী কর্মকারকে বিয়ে দিয়েছি। বড় ছেলে কালাচাঁন কর্মকার আমার সাথে কামারের কাজ করে।মেঝ ছেলে পবিত্র কর্মকারের আলাদা দোকান। আর ছোট ছেলে বিপ¬ব কর্মকার কোটালীপাড়ায় একটি স্বর্ণের দোকানে কাজ করে।

মুক্তিযোদ্ধা গোপাল চন্ত্র কর্মকার ভাঙ্গা গলায় বলেন, দেশ স্বাধীনের পর থেকে কয়লার আগুনে লোহা পোড়ানো ও হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছি। সারাদিন কাজ শেষে ৩/৪’শ টাকা আয় হয়। তার অর্ধেক ভাগাভাগি হয়।এখন বয়স হয়েছে শরীরের সাথে পেরে উঠি না। তার পর আবার ব্রেইন স্ট্রোকে স্ত্রী ঘরে শোয়া। প্রতিদিন ওষুধ লাগে, সব কিছু কিনে খেতে হয়। তিন ছেলে সবাই বিয়ে করে আলাদা থাকে। দোকানেতো রান্নার জায়গা নেই তাই মেঝো ছেলের বাসায় টাকা দিয়ে খেতে হয়। আমার কোন জায়গা জমি নেই। ঘর নেই তাই অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে দোকানের মেঝেতে রাত কাটাই। মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ি । কাজ করতে পারিনা। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ঘুরেই কার্ড পেয়েছে। ভাতা পাচ্ছে। আর আমি জীবন বাজি রেখে যে কাজ করেছি আমার কোন কার্ড (সার্টিফিকেট) নাই। ভাতা ও নাই। জীবনের শেষ সময় সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চাই, মাথা গোজার ঠাই চাই, আর ভাতা চাই।

গোপাল চন্দ্র কমৃকারের বড় ছেলে কালাচাঁন কর্মকার ও মেঝে ছেলে পবিত্র কর্মকার জানান, বাবা আমাদের কাছে মাঝে মধ্যে ৭১ এর যুদ্ধের গল্প করে দুঃখ করেন আর বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম।আমাদের বাড়িতে হেমায়েত বাহনীর অস্ত্রাগার ছিলো। আমার বাবা সব সময় হেমায়েত উদ্দিন, কমলেশ ও বিষ্ণুপদ কর্মকারের সাথে থাকতেন। বাবা ছিলেন অশিক্ষিত। তাই যুদ্ধের পর সার্টিফিকেট আনেনি।

তারা আরো বলেন,আমরাও অভাবের কারণে লেখা-পড়া শিখতে পারিনি। এখন বাবার বয়স ৭০ বছর। বাবা আগের মতো কাজ করতে পারেন না। তাই আমরা তার মৃত্যুর আগে মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি ও ভাতার দাবি জানাই।


গোপাল চন্দ্র কর্মকারীর স্ত্রী বেলারানী কর্মকার বলেন, বিয়ের পর থেকে শুনছি আমার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার সাথে বিভিন্ন সময় যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে গল্প করেছেন। এতোদিনেও কেউ তার খোজ নেয়নি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিও দেননি। এখন বয়স হয়েছে, ঠিক মতো কাজ করতে পারেননা। আমি নিজেও অসুস্থ । যা আয় করে আমাদের টাটানি করে চলতে হয়। তাই আমি সরকারের কাছে সাহায্য চাই। তিনি যেন মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেয়ে ভাতা পায়।

হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রম বলেছেন, গোপাল চন্দ্র কর্মকার একজন প্রকৃত মক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় তার সাহসী ভুমিকা ছিল। বড় বড় দুইটি যুদ্ধে সে অংশ নিয়েছে। এর পর থেকে তাকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ পৌছানোর কাজ করাতাম। দেশ স্বাধীনের পর তাকে অনেক খুজেছি। সেও আমার কাছে আসেনি, সাটিফিকেটও নেয়নি। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর তার সন্ধান পেযেছি। সে যাতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমি নিজে করে দিব।

(এমএইচএম/এএস/ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪)