আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : রাজাকার নামের শকুনের থাবায় আমার মতো হাজারো নারী তার মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছে। যে কারণে আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। ভেঙ্গে গেছে আমার সুখের সংসার। ৪৩ বছর ধরে যে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি, সেই রাজাকার মুক্ত স্বাধীন দেশ দেখে মরতে চাই। সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সকল যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারদের যেন অনতিবিলম্বে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।

আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলেছেন, দীর্ঘ ৪৩ বছর পর্যন্ত ধামাচাঁপা পরে থাকা স্বাধীনতা যুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস বীরাঙ্গনা বিভা রানী মজুমদার (৬০)। সংসার হারিয়ে বরিশালের গৌরনদী পৌর এলাকার টরকীর চর এলাকায় ভাই উপেন্দ্র নাথ মণ্ডলের আশ্রয়ে রয়েছেন বিভা রানী। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আল-বদর, রাজাকারদের লালসার স্বীকার বিভা রানী। জীবন আর যৌবন উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার জন্য। হায়নার দল নারী জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ লুটে নিয়েছে শকুনের মতো। দেশের স্বাধীনতার সুখ ভোগ করার অতৃপ্ত আশা নিয়ে সেসময় সব নির্যাতন আর যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করেছেন। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হলেও বিভা রানীর খবর নেয়নি কেউ।

সোমবার সকালে বিভা রানীর আশ্রয়স্থলে গেলে প্রথমে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি। অনেক চেস্টার পরে রোগে, শোকে ভুগে খেয়ে না খেয়ে আধমরা অবস্থায় বেঁচে থাকা বিভা রানী মুখ খোলেন। তার জীবনের শেষ ইচ্ছা মরার আগে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত আর রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই। একটি ঝুপড়ি ঘরে বসে একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠলেও অর্থের অভাবে তিনি নিজের ও পুত্রের চিকিৎসা করাতে পারছেন না।

আলাপকালে বিভা রানী আবেগ জড়িত কন্ঠে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ৭১ সালের সেই করুণ কাহিনীগুলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল মুহুর্তে চর আইরকান্দি গ্রামের রমেশ মণ্ডলের সুন্দরী টগবগে কন্যা বিভা রানী পাশ্ববর্তী বীরেন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। সেখানে পালিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি তার। পাক সেনাদের দোসর স্থানীয় রাজাকার আইউব আলী বেপারীর নেতৃত্বে ৭/৮ জন আল-বদর রাজাকাররা অব্যাহত ভাবে তার ওপর চালায় বর্বরোচিত পাশবিক নির্যাতন। দেশ স্বাধীনের পর পরই টরকীর চর এলাকার বৃন্দাবন মজুমদারের পুত্র নকুল মজুমদরের সাথে বিভা রানীর বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামী ও তার পরিবারের লোকজনে বিভা রানীর ওপর পাশবিক নির্যাতনের খবর জানতে পারার পরেই শুরু হয় দাম্পত্য কলহ।

১৯৭২ সালের শেষদিকে নকুল মজুমদার তার স্ত্রী বিভা রানীকে ফেলে ভারতে আত্মগোপন করেন। দীর্ঘদিনেও সে ফিরে না আসায় ১৯৭৪ সালে স্বামীর খোঁজে ভারতের উত্তর প্রদেশে যান বিভা। সেখানে বিভিন্ন বাসায় ঝিয়ে কাজ করার ফাঁকে স্বামীকে খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে স্বামীর দেখাও মিলে যায়। তার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন বিভা। দেশে ফিরে এসে বিভা দিশেহারা হয়ে পরেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তবে যেখানেই তিনি কাজ শিখতে গিয়েছেন সেখানেই তিনি নানা হয়রানির স্বীকার হয়েছেন। ১৯৭৮ সালে তার (বিভার) বাবা রমেশ মন্ডল মারা যাওয়ার পর বিভার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।

মা, চার বোন ও এক ভাইয়ের সংসারের সবচেয়ে বড় সন্তান বিভার কাঁধে ওঠে সংসারের পুরো দায়িত্ব। এজন্য তাকে (বিভাকে) রাজমিস্ত্রির সহকারি, জমিতে দিনমজুরের কাজসহ সব ধরনের শ্রম বিক্রি করতে হয়েছে। ১৯৮৮ সালের প্রথমার্ধে নকুল দেশে ফিরে আসেন। কয়েক মাস বিভার সাথে থেকে পুনরায় ভারতে চলে যান। সেখানে গিয়ে সে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পরবর্তীতে বিভার গর্ভে জন্মনেয় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী পুত্র সন্তান সাগর। একে তো স্বামীর আত্মগোপন, দ্বিতীয়তো জন্ম নেয়া ছেলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ায় বিভা রানী আরো দিশেহারা হয়ে পরেন। পরবর্তীতে সেলাই কাজের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সংসারের হাল ধরেন বিভা। বর্তমানে বয়স বেড়ে যাওয়ায় তাও করতে পারছেন না।

বিভা রানী বলেন, রাজাকার মুক্ত স্বাধীন দেশ ও তার প্রতিবন্ধী ছেলের সুচিকিৎসা, দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা এবং রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়ে মরতে পারলে তিনি মরেও শান্তি পাবেন। সম্প্রতি সময়ে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী অনলাইনে আবেদনও করেছেন বিভা রানী।

(টিবি/এএস/ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪)