আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রেমিটেন্সের উৎস লাখ লাখ প্রবাসীদের ‘ভোটাধিকার’ না দিয়ে, পরিবার পরিজনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধে দায়িত্বহীনতা দেখিয়ে, কষ্টার্জিত বিনিয়োগের নিরাপত্তার বিষয়ে উদাসীন থেকে, দূতাবাসগুলোতে হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, জাতীয় সংসদে প্রবাসীদের কোটাভিত্তিক আসন বরাদ্দ না রেখে সর্বোপরি প্রবাসীদের বিশেষ কোন ‘প্রায়োরিটি’ না দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করে ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস’ পালনের যৌক্তিকতা কতটুকু তথা এর নৈতিক দিকটি এখন সময় এসেছে ভেবে দেখার।

আঠারই ডিসেম্বর ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেন্টস ডে। বিশ্বব্যাপী অভিবাসী শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা এবং তাঁদের পরিবার-পরিজনেদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ ১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক চুক্তি ৪৫/১১৮ প্রস্তাব আকারে গ্রহণ করে। পরে ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নেয় দিবসটি সারা বিশ্বে উদযাপনের। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইমিগ্রান্টদের অধিকার আদায় সহ স্বার্থ রক্ষার্থেই দিবসের উৎপত্তি। যদিও দিবসটির তাৎপর্য থেকে যোজন যোজন দূরে বাংলাদেশ তথাপি এ উপলক্ষ্যে যথারীতি বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।

বিশ্বব্যাংকের দেয়া সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক, বিশ্বের রেমিটেন্স প্রাপক দেশের তালিকায় এখন অষ্টম স্থানে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত পাঁচ বছরের পরিসংখান থেকে দেখা যায়, ২০১০ সালে ১১ হাজার ৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলার, ২০১১ সালে ১২ হাজার ১৬৮ কোটি ৯ লাখ ডলার, ২০১৩ সালে ১৪ হাজার ১৬৩ কোটি ৯৯ লাখ ডলার, ২০১২ সালে ১৩ হাজার ৮৩২ কোটি ১৩ লাখ ডলার এবং ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ হাজার ৫৭০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার দেশে প্রেরণ করেন সারা বিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অথচ কোন সরকারই আজ অবধি অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকাশক্তি এই প্রবাসীদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়নি।

প্রবাসীদের স্বার্থরক্ষা তথা কল্যাণ নিশ্চিত করতে ‘প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রনালয়’ নামে একটি ‘আইওয়াশ মিনিস্ট্রি’ থাকলেও তা এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশির তেমন কোন কল্যান সাধন করতে পারেনি কোন কালেই। গত দুই যুগ দেশ শাসনকারী বিএনপি ও আওয়ামী লীগ রীতিমতো পাল্লা দিয়ে উদাসীন থেকেছে প্রবাসীদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সুবাদে একজন অদক্ষ আনাড়ি অনভিজ্ঞ অবিবেচক ও উদাসিন ব্যক্তি গত ছয় বছর মন্ত্রী পদে আসীন প্রবাসীকল্যান মন্ত্রনালয়ে। বহুবিধ কারণে দেশে-বিদেশে প্রবাসীদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত আজ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

প্রচন্ড জেদি প্রকৃতির খন্দকার মোশাররফ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কয়েক মাস আগে সাংবাদিক মুন্নি সাহার একটি অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে পেঁয়াজ-মরিচের সাথে তুলনা করার স্পর্ধা দেখান। সরকারের ভুল পলিসি জি-টু-জির খেসারতে মালয়েশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানির ধ্বংস সংক্রান্ত মুন্নি সাহার এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন তখন প্রতাপশালী এই মন্ত্রী। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে দু’বছর আগে প্রাইভেট সেক্টর বন্ধ করে দিয়ে গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি-টু-জি) এই আত্মঘাতী পলিসি চালুর ‘নেপথ্য-ভিলেন’ তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় হবার সুবাদে অহংকারী মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ বছরের পর বছর রয়ে গেছেন যে কোন প্রকার জবাবদিহিতার উর্ধ্বে। পেঁয়াজ-মরিচের সাথে প্রবাসীদের তুলনা করার পরও তার কোন শাস্তি না হওয়ায় একই ধরনের কটুক্তি করতে মুখে আটকায়নি সরকারের এক সময়ের আরেক প্রতাপশালী মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীরও। নিউইয়র্কে যে অনুষ্ঠানে তার কপাল পুড়েছিল কয়েক মাস আগে, সেখানে স্থানীয় প্রবাসীদের সরাসরি ‘কামলা’ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন ‘সিদ্দিকী পরিবারের কলংক’ আবদুল লতিফ। “আপনারা বিদেশে এসেছেন কামলা দিতে এবং সবসময় কামলাই দিয়ে যাবেন” – এমন কথা লতিফ সিদ্দিকীর পঁচামুখ দিয়ে সেদিন বের হলেও নগদ গনধোলাই থেকে বেঁচে যান তিনি।

নাটক-সিনেমা যেহেতু জীবনেরই প্রতিচ্ছবি তাই সম্পূর্ণ অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে নাটকে বা সিনেমায় তথা যে কোন মিডিয়া প্রোডাকশনে প্রবাসীদেরকে কেউ হেয় প্রতিপন্ন করলে তার শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায়। প্রবাসীদের আরো দুর্ভাগ্য, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্সে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সমৃদ্ধ হলেও তাঁদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের তরফ থেকে ‘প্রতিশ্রুতি’ থাকলেও বাস্তবায়নের নামগন্ধ নেই কোথাও। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বারবার ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছেন প্রবাসীদেরকে ভোটাধিকার দেবেন বলে। ইউরোপ-আমেরিকায় কয়েক মাস পরপর বিশাল গনসংবর্ধনায় খেটে খাওয়া প্রবাসীদের সাথে ভোটাধিকার ইস্যুতে যেভাবে মিথ্যাচারটি তিনি করে আসছেন তাতে করে তিনি কিন্তু নিজেই নিজেকে ছোট করছেন প্রতিনিয়ত।

প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে ভোটার তালিকার বাইরে রাখা কেন শতভাগ অগনতান্ত্রিক ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না ? – এইমর্মে উচ্চ আদালতে একটিমাত্র রিটই চোখ-কান খুলে দিতে পারতো সরকারের, এমনটা মনে করছেন দেশ-বিদেশের বিশ্লেষকরা। প্রবাসী প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের যার যার দেশ থেকে ভোটদানের সুযোগ ব্যতীত বাংলাদেশের যে কোন জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হলেও সুষ্ঠ অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হবার যে ন্যূনতম সুযোগ নেই – এ নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে অতীতে। কানে পানি যায়নি কারো আজ অবধি। প্রবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিশেষ এই ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলই তাদের দেউলিয়াত্ব দেখায় বছরের পর বছর।

প্রতিবেশী ভারত সরকার তাদের ‘সোনার সন্তান’ অনাবাসী ভারতীয়দেরকে ‘এনআরআই’ হিসেবে শুধু সম্মানই করছে না, একইসাথে দিচ্ছে বহুবিধ ‘প্রায়োরিটি’। অথচ অনাবাসী বাংলাদেশিরা কি বিএনপি কি আওয়ামী লীগ সব সরকারের কাছ থেকেই ‘দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক’-এর ‘ট্রিটমেন্ট’ বৈ অন্য কিছু পায়নি। ‘এনআরবি’ জনগোষ্ঠীর রক্ত পানি করা রেমিটেন্সের কোটি কোটি ডলার ভেঙ্গেই মহাজোট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ ভ্রমণের বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন, পেয়েছিলেন ‘ফ্লাইয়িং ফরেইন মিনিস্টার’ খেতাব। বিনিময়ে প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের সাথে বাড়ান বাংলাদেশের কূটনৈতিক দূরত্ব।

শুধু ভোটাধিকার বা বিশেষ প্রায়োরিটিই নয়, মহান জাতীয় সংসদে প্রবাসীদের হয়ে কথা বলার মতো নেই কোন সাংসদ বা প্রতিনিধি। ঢাকার বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে সরকার নির্বিকার। বিশ্বব্যাপী চিহ্নিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে নিরীহ প্রবাসীদের হয়রানি থেমে নেই। প্রবাসীদের পরিবার-পরিজন যখন দেশজুড়ে ভোগে নিরাপত্তাহীনতায়, প্রবাসীদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা যখন নিশ্চিত করতে পারে না সরকার, তখন এসব নিয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রচার মাধ্যমের নিরব ভূমিকাও রীতিমতো প্রশ্নবোধক। শতাধিক দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করে আসছেন মাতৃভূমির প্রচার মাধ্যম কর্তৃকও তাঁদেরকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ার বিষয়টি।

দেশের জনসংখ্যার ১৬ বা ১৭ ভাগের ১ ভাগ যদি প্রবাসী জনগোষ্ঠী হয়ে থাকেন, সেই অনুপাতে বাংলাদেশের সরকারী-বেসরকারী রেডিও-টিভি ও পত্র-পত্রিকা সহ যাবতীয় প্রচার মাধ্যমসমূহ তাদের ১৬ বা ১৭ ভাগ সময় বা স্পেস এক কোটি প্রবাসীর জন্য বরাদ্দ করতে পারেনি বা করার প্রয়োজন মনে করেনি। এতে প্রতীয়মান হয়, এক কোটি প্রবাসীর ন্যায্য অধিকার এবং তাঁদের এবং পরিবার-পরিজনেদের স্বার্থরক্ষায় সরকারের মতো প্রচার মাধ্যমগুলোও কোন অংশেই কম উদাসীন নয়। এমতাবস্থায় প্রতি বছর ১৮ই ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় বেহুদা ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস’ পালনের নামে তামাশার সীমানা পেরিয়ে কেন এই প্রহসন ? প্রবাসীদের মাথায় কাঠাঁল ভেঙ্গে খাওয়ার দিন শেষ হবে কি ?


(এমইএন/পি/ডিসেম্বর ১৮, ২০১৪)