বাগেরহাট প্রতিনিধি : সুন্দরবনে অয়েল ট্যাংকার দূর্ঘটনায় প্রায় একশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ার পর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়েছে সুন্দরবন। পরিবেশবাদী ও সুন্দরবন বিশেষঞ্জরা সরেজমিন ঘটনাস্থল ঘুরে এমন আসংঙ্কার কথা জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে পূর্বসুন্দরবন বিভাগের জয়মনি এলাকায় থেকে আন্ধারমানিক পর্যন্ত প্রায় একশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে শ্বাসমূলসহ ঘাস ও লতাগুল্মে তেলের আস্তরন পড়ায় হরিণের খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। হরিণ এখন খাদ্যের খোঁজে অপেক্ষাকৃত উচুঁ এলাকা (টিলারমত) বন বিভাগের অফিসগুলোতে এসে জড়ো হচ্ছে।

শ্যালা নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর ইরাবতি ডলফিনসহ ছয় প্রজাতির ডলফিনের অভয়ারণ্য ক্ষতিগ্রস্থ হবার পর ডলফিন সুন্দরবন ছেড়ে যায়নি। ডলফিনগুলো এখন শ্যলা নদীর ভাটিতে বলেশ্বর মোহনায় এসে দল বেঁধে আশ্রয় নিয়েছে। শ্যালা নদীর ভাসমান তেল অপসারন ও উজানে বঙ্গোপসাগরে ভেসে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলেও এখনও শ্যালা অভয়াশ্রমে ফিরে আসেনি ডলফিন। শুক্রবার সুন্দরবন সফর শেষে সাংবাদিকদের খোদ পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দু‘এক বছরের মধ্যে সুন্দরবন স্বাভাবিক হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। মন্ত্রি আরো বলেছেন, সুন্দরবনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয়ক্ষতি নিরূপন ও তা কাটিয়ে উঠতে জাতিসংঘের সহযোগীতায় বিশেষজ্ঞদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হবে। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, আজ রবিবার শেলা নদীর আশ-পাশের বনের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে জাতিসংঘের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি প্রতিনিধি সুন্দরবনে আসছেন। এই প্রতিনিধি দল ৪-৫ দিন সরেজমিন পরির্দশন ও নানা বিষয় নিয়ে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করবেন বলে জানান ডিএফও।


অন্যদিকে সুন্দরবন বিভাগ ম্যানগ্রোভ এবনের শ্বাসমূল ও গাছের গোড়া থেকে পানি স্প্রে করে লেগে থাকা তেল অপসারনের যে কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছিল তা বাতিল করেছে। পানি স্প্রে করে সাফল্য না আশায় তা বাতিল করা হয়েছে। এখনও বন সন্নিহিত লোকালয়ের সাধারন মানুষ ও জেলে-বনজীবীরা সনাতন পদ্ধতিতে গাছে লেগে থাকা ও ভাসমান তেল সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শনিবার সংগৃহিত হয়েছে মাত্র ১৪শ’ লিটার। এনিয়ে সর্বমোট পদ্ম অয়েল কোস্পানী সংগৃহিত ৬৭ হাজার ২শ’ লিটার তেল কিনে নিল।

বন বিশেষজ্ঞদের অভিমত

সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনের শ্যালা নদীর ভাষমান তেলের কারণে জয়মনি থেকে ভাটিতে আন্ধারমানিক পর্যন্ত প্রায় একশ কিলোমিটার বনভুমির শ্বাসমূলসহ জলাভুমিতে তেলের আস্তরন লেগে থাকার কারনে এসব এলাকার খাল-নদীনালা সন্নিহিত যেসব গাছপালার শ্বসমূলে তেলের আস্তরণ পড়েছে সেসব গাছ ধিরে ধিরে মরতে শুরু করবে। এবিশাল এলাকার ঘাসগুলোতে তেলের আস্তরণ পড়ায় ঘাসগুলো মরে নতুন ঘাস না ফোটায় হরিনের খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বনবিভাগের লোকজন তাকে জানিয়েছেন খাদ্যের অভাবে হরিন এখন অপেক্ষাকৃত উচুঁ এলাকা বনবিভাগের অফিস প্রাঙ্গনে এসে ভিড় করছে। শ্যালা নদী থেকে ভাসমান তেল চলে গেলেও এই অভয়াশ্রমে এখনও ফিরে আসেনি ডলফিন। নদীর তলদেশে ডলফিনের আশ্রয়স্থলে কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে তা এখনও নিরুপন করা সম্ভব হয়নি। তেলের কারনে সুন্দরবনের এ বিশাল এলাকায় দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব পড়বে বলে আসংখ্যা প্রকাশ করেছেন এই পরিবেশবিদ ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞের। একই অভিমত ব্যাক্ত করে পরিবেশ আন্দোলন মংলা উপজেলা সভাপতি নূর আলম জানান, তেলের কারনে যেসব গাছ মারা যাবে সেখানে গাছ জন্মমাতে আনেক সময় লাগবে। খাদ্য সংকটের কারনে হরিণ বনের অনাত্র চলে যাবে। এত বনের জীব বৈচিত্র্যে সংকট দেখা দেবে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, রবিবার বনের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে জাতিসংঘের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি প্রতিনিধি সুন্দরবনে আসছেন। সুন্দরবনের দীর্ঘস্থায়ী কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপন ও ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কতো দিন সময়ের প্রয়োজন সে বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্বের সাথে গ্রহন করবে সরকার। সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওযায় কোন ঝুকি নিতে নারাজ বন বিভাগ। জাতিসংঘের এই প্রতিনিধি দল ৪-৫ দিন সরেজমিন পরির্দশন ও নানা বিষয় নিয়ে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করবেন বলে জানান ডিএফও।

তদন্ত উঠে আসতে পারে যে সুপারিশ

আজ রবিবার পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির দাখিলকৃত প্রতিবেদনে উঠে আসতে পারে যেসব সুপারিশ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, অনতিবিলম্বে মোংলা-ঘসিয়াখালী নৌ-রুট চালু করার ব্যবস্থা করা। বিকল্প নৌরুট চালু না হওয়া পর্যন্ত সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শেলা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল যদি একান্ত প্রয়োজন হয় তবে বনের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি জাহাজে নিয়মানুযায়ী বিআইডাব্লি¬উটিএ কর্র্তৃক অনুমোদিত ও দক্ষ পাইলট থাকতে হবে। সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জয়মনিরঘোল-আন্দারমানিক-হরিণটানা-দুধমুখী-শরনখোলা-বগী পথে একই জোয়ার এবং একই ভাটায় জাহাজসমূহ সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকা অতিক্রম করতে হবে। সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে চলাচলকারী জাহাজসমূহে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর থেকে সঠিক কাগজপত্র থাকতে হবে। সুন্দরবনে স্বল্প গতিতে জাহাজ চলাচল করতে হবে। নির্ভরযোগ্য সুত্রে এতথ্য পাওয়া গেছে।

১১ বছরেও ডকিং করা হয়নি ট্যাংকারটি

‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ ছিলো বালু ও পাথর টানার কার্গো। এটি নির্মিত হয় ১৯৯৮ সালে। এর মূল মালিক ছিলেন মানিকগঞ্জের আরিচা এলাকার শিল্পপতি আব্দুর রহিম খাঁন। তিনি ‘আল-মামুন’ নাম দিয়ে বুড়িগঙ্গা ও মেঘনা রুটে এটি পাথর টানার কাজে ব্যবহার করতেন। এর কিছু দিন পর তার মত পরিবর্তন করে কার্গোটিকে ‘ওটি আল-মামুন’ নাম দিয়ে ডিপো থেকে তেল ক্রয় করে বিভিন্ন নৌযানে সরবরাহ করতেন। ২০০৩ সালে ট্যাংকারটির নাজুক অবস্থা হলে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। পরে এটি বর্তমান এক মন্ত্রীর শ্যালক আমীর হোসেন ফরিদ ‘ওটি আল-মামুন’ ট্যাংকারটি কিনে নেন। পরে তিনি ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নাম দিয়ে খুলনা থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ভোলা পাওয়ার প্লান্টে তেল টানার কাজে ব্যবহার শুরু করেন। প্রতি পাঁচ বছর পর এসব নৌযান ডকিং করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ১১ বছরেও করা হয়নি কোন ডকিং কাজ। এরপরও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের (ডস) বরিশাল কার্যালয়ের ‘ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার’ (প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক) মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকার এটির অনুকূলে ফিটনেস সনদ প্রদান করেন। জানাগেছে, গত তিন বছর ধরে জাহাজটির বার্ষিক সার্ভে বা ফিটনেস দিয়ে আসছেন সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা। সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্র“য়ারি এটির ফিটনেস দেয়া হয়। দুর্ঘটনার পর সুন্দরবনে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেয়া ও দুর্ঘটনা তদন্তে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের দু’টি আলাদা তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান শুরু করে

বিএনপির ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি

সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবিতে পরিবেশ বিপর্যয়ের সুষ্ঠু তদন্তের লক্ষ্যে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এই কমিটি গঠন করেন। বোরবার থেকে এই কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করবে বলে বিএনপির এক নেতা জানান। তাদের ২৫ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটিতে রয়েছেন-বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু, খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, খুলনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মনা, বাগেরহাট জেলা সভাপতি এমএ সালাম, পরিবেশ আন্দোলনের নেতা ড. শফিকুল ইসলাম, পরিবেশ সাংবাদিক কামরুল ইসলাম চৌধুরী।

(একে/পি/ডিসেম্বর ২০, ২০১৪)