গাজীপুর প্রতিনিধি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারারক্ষীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, কেউ আইন শৃংখলার বাইরে নয়। তাই জঙ্গী, সন্ত্রাসী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়তা প্রদান করলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার সকালে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার প্রাঙ্গনে ‘জাতীয় কারা সপ্তাহ-২০১৪’এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, স্বরাষ্ট্র সচিব মোজাম্মেল হোসেন খান, আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, জেলা পরিষদের প্রশাসক ও সাবেক এমপি আখতারউজ্জামান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ নূরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ হারুন অর রশীদসহ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।

শেখ হাসিনা কারারক্ষী ও ও কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে আরো বলেন, দেশের আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে ‘ক্রিমিনাল ডাটাবেইজ’ তৈরী করা প্রয়োজন। এই ডাটা বেইজের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তথ্যের সমন্বয় করে সহজেই অপরাধী বা ভূয়া পরিচয় প্রদানকারীকে সনাক্ত করা যাবে। এ উদ্দেশে কারাগারে আসা বন্দিদের ডাটাবেইজ তৈরীর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

তাছাড়া কারাগারে আটক অপরাধীদের শৃংখলার মধ্যে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, কোন অপরাধীই যেন কারাগারে এসে আরো বড় অপরাধী হয়ে বের না হয়। কারাগারে আসা বন্দিদের ‘বন্দি হিসেবে নয়’ সমাজের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সমাজের একজন সদস্য করগারের পরিবেশের কারণে অপরাধী হয়ে বের হলে, সমাজ আরো কুলষিত হবে। তাই বন্দীদের সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ ভাবে আটক রেখে তাদের প্রতি মানবিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ‘পাপকে ঘৃনা কর, পাপিকে নয়’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দীর্ঘ সাত বছর পর কারা সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। কারা সপ্তাহ পালনের মধ্য দিয়ে কারারক্ষীদের কর্মস্পৃহা আরো বৃদ্ধি পাবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকার সব সময় কারাগারের পরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। ১৯৯৬ সালে রাস্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আমরা কারা বিভাগের সদর দপ্তরসহ ৩৬টি কারাগার নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। যার সুফল বর্তমানে কারাবন্দিসহ পুরো প্রশাসন পাচ্ছে। বন্দিদের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাসহ স্বাস্থ্য পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে’।

তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার ‘কারা স্মৃতি যাদুঘর’ স্থাপন করি। এটি জাতীয় যাদুঘরের শাখা যাদুঘরের শাখা যাদুঘর হিসেবে অন্তর্ভক্ত করা হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের পর এ যাদুঘর দু’টি সর্ব সাধারনের জন্য খুলে দেয়া হবে। এতে মানুষ জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার কারাবাস কালীন স্মৃতি সম্পর্কে সম্মক ধারণা পারেন। এ ছাড়াও আমরা একশ বছরের পুরোনো, জরাজীর্ণ খুলনা জেলা কারাগারকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বৃহৎ আকারে নির্মানের কাজ শুরু করেছি। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারকেও আরো বড় পরিসরে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এতিমধ্যে বাহ্মনবাড়িয়া, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, মেহেরপুর, গোপালগঞ্জ, নীলফামারী এবং নেত্রকোনা জেলায় নতুন কারাগার চালু হয়েছে। এ ছাড়া দিনাজপুর সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ফেনী, মাদারীপুর ও পিরোজপুর জেলায় নতুন কারগার নির্মাণের কাজ চলছে। চট্টগ্রাম কারাগারের আধুনিকায়নের কাজ চলছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঝুঁকিপূর্ণ পেরিমিটার ওয়ালের স্থলে নতুন পেরিমিটার ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে’।


তিনি বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার এবং কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে শিশুদের ডে কেয়ার সেন্টার চালু করেছি। কারা কর্মকর্তাদের জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় অফিসার্স মেস নির্মাণ করা হয়েছে। কারারক্ষীদের প্যারেড প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণের ব্যবস্থা আমরাই করেছি। বেশ কিছু কারাগারে মহিলা কারারক্ষীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের আবাসনের সমস্যা সমাধানের আরো একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে’।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪৩ বছরেও কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কোন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেনি। কারা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য রাজশাহীতে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি এবং ঢাকায় একটি কারা স্টাফ কলেজ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও দেশ ও জাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জঙ্গি এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীরা যাতে কারাগারের ভেতর থেকে জঙ্গি তৎপরতা বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে না পারে, সে লক্ষ্যে কারা নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার’।

শেখ হাসিনা কারা বিভাগের উদ্দেশ্যে নেওয়া অন্যান্য প্রদক্ষেপের বিষয়ে বলেন, বর্তমানে কারা বিভাগে আরো বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে কারা বিভাগকে আরো যুগোপযোগী করার জন্য সরকার আন্তরিক ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কারা প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, বন্দিরা সাজাভোগ শেষে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যাতে সমাজে পুনর্বাসিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সুযোগ পায় সে জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি আমরা গ্রহণ করেছি।

তিনি বলেন, কারা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কল্যাণে প্রায় দুই একর জায়গায় পার্কিং ব্যবস্থাসহ বহুতল কনভেনশন সেন্টার স্থাপন করার পরিকল্পনা আছে। যেখানে সিনেপ্লেক্স, সুইমিংপুল, জিমন্যাশিয়ানসহ অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। এখান থেকে অর্জিত আয় কারা কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। বাকি অংশে কারা প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট নিমাণ করা হবে।

তিনি বলেন, আওয়ামীলীগ যখনই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে, দেশকে এগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ আজ মুখাপেক্ষি দেশ নয়। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। আমরা খাদ্যে সয়ং সম্পূর্ণতা পেয়েছি। মৎস উৎপাদনে পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ। তৈরী পোশাক রফতানিতে বিশ্বের আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ২০০৬ সালে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বর্তমানে ২২ দশমিক ৩৯ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ৬৩০ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১২’শ ডলারে উন্নীত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে সরকারি- বেরকারি মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াটে পৌছেছে। ১৪টি বৃহৎ সেতু, ৪ হাজার ৫০৭টি মাঝারি ও ছোট সেতু, ১৩ হাজার ৭৫১টি কালভার্ট এবং ২১ হাজার কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। নিজস্ব তহবিলে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেছি। সারাদেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়েছে। ১২ হাজার ৫৫৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ৩ হাজার ৮৮১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। আগামি পহেলা জানুয়ারি সারাদেশে সাড়ে ৩২ কোটিরও বেশি পুস্তক বিতরণ করা হবে।

এর আগে সকাল ১০টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান মঞ্চের সামনে এসে পৌঁছলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক এমপি, স্বরাস্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন তাঁকে স্বাগত জানান। পরে প্রধানমন্ত্রী কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার প্যারেড গ্রাউন্ডে প্যারেড পরিদর্শন ও সশস্ত্র অভিবাদন গ্রহণ করেন। জাতীয় কারা সপ্তাহের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর তিনি কারা মেলা ও প্রদর্শনী কেন্দ্র উদ্বোধন এবং পরিদর্শন করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দরবারে উপস্থিত হয়ে কারারক্ষী, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। এ সময় মঞ্চে স্বরাস্ট্র প্রতিমন্ত্রী, কারা মহা পরিদর্শক উপস্থিত ছিলেন।

(এসএএস/এএস/ডিসেম্বর ২৩, ২০১৪)