আহসানুল করিম : ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে অয়েল ট্যাঙ্কার ডুবিতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় দীর্ঘমেয়াদী হুমকির মুখে পড়েছে ম্যানগ্রোভ এবনের জলজ প্রাণীসহ জীব বৈচিত্র্য। তেল নি:সরনের কারণে সুন্দরবনের নদ-নদীর পানিতে মাছের ডিম, রেণু পোনা, জলজ প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

কুমির, ডলফিন, শূকর, হরিণসহ সুন্দরবনের প্রাণীর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের গবেষক দল তেল ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সুন্দরবনের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তেলের প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করে। এই গবেষণা পত্রে দেখা গেছে, বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদী ও আশপাশের তেল ছড়িয়ে পড়ার আগে ৩১ থেকে ৪৩ ধরনের মাছ পাওয়া যেত। তেল ছড়ানোর পর এ অঞ্চলের ওপর গবেষণায় পাওয়া গেছে ১০ থেকে ১৪ ধরনের মাছ। মাছরাঙা, বকসহ ৫৭ ধরনের পাখি তেল ছড়িয়ে পড়ার আগে দেখা গেলেও এখন মিলছেনা মাছরাঙার দেখা। শীতে সুন্দরবনের শ্যালা এলাকায় অতিথি পাখির ঢল নামলেও তেল ছড়িয়ে পড়ার পর কোনো অতিথি পাখি দেখা যায়নি। সুন্দরবন অঞ্চলে ৩ প্রজাতির গুইসাপ রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২১ থেকে ২৭টি গুইসাপ দেখা গেলেও তেল ছড়িয়ে পড়া অঞ্চলে দুটি গুইসাপ দেখা গেছে। সেগুলোর গায়ে ছিল তেলের প্রলেপ। এখানে ৩৪টি প্রজাতি ব্যাঙের রেণু, যা ব্যাঙাচির মধ্যে পাওয়া গেছে মাত্র ৮টি প্রজাতি। তেল ছড়ানোর পর বাকি ২৬টি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তেল ছড়ানোর কারণে সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরী গাছের বংশবিস্তারের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সুন্দরী ফলের ৯৫ শতাংশের ভ্রূণই নষ্ট হয়ে গেছে। আক্রান্ত অঞ্চলে দুই ধরনের শৈবালের উপস্থিতি দেখা যেত। এর মধ্যে লাল শৈবাল হিসেবে পরিচিত উদ্ভিদের শিকড় ও শ্বাসমূলের সঙ্গে লেগে থাকত।

এগুলো বিভিন্ন জলজ প্রাণীর খাদ্য ও পুষ্টির জোগানদাতা হিসেবে কাজ করে থাকে। আক্রান্ত অঞ্চলে লাল শৈবালের ৯৫ শতাংশই মরে গেছে। এ ছাড়া বাদামি শৈবালের দুটি প্রজাতি আক্রান্ত অঞ্চল থেকে উজাড় হয়ে গেছে। বাদামি শৈবাল সাধারণত ছোট ছোট খালের পাশে জন্মায়।
গবেষণায় উঠে এসেছে, তেলের কারণে শ্যালা নদীসহ অর্ধ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ছোট খালগুলোতে তেলের আস্তরণ পড়েছে। এসব তেল জোয়ারের সময় নদীর উপরিভাগে চলে এসেছে। এ কারণে নদীর উপরিভাগের বৃক্ষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি এসব অঞ্চলে মাটিতে থাকা প্রাণী মারা যাবে।

এ ছাড়া সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে কুমিরের। কুমির ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে ডলফিন। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হবে। পানির অভ্যন্তরের পরিবর্তন ও তার ফলে বনের পশু-পাখি ও গাছপালার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে খোরশোলা ও পারসে মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম শুরু। আর শ্যালা নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ে ৯ ডিসেম্বর থেকে। মৎস্য প্রজনন মৌসুমে এ অঞ্চলের প্রতি লিটার পানিতে খোরশোলা, পারসে, বাগদা ও হরিণা চিংড়ির ডিম ও রেণু পাওয়া যেত এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার।

গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের পানিতে কোনো ডিম ও রেণু পোনা নেই। পারসে, খোরশোলা, বাগদা ও হরিণা চিংড়ির পোনা কৃত্রিমভাবে হ্যাচারিতে তৈরি হয় না। এটা সুন্দরবন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। সুন্দরবন এলাকায় চার প্রজাতির কাঁকড়া দেখা যায়। প্রতি বর্গকিলোমিটারে সুন্দরবনের স্বাভাবিক অবস্থায় কাঁকড়া দেখা যায় ৩ থেকে ৭টি। তবে গবেষণা এলাকায় কোনো জীবিত কাঁকড়া দেখা মেলেনি।

কাঁকড়া হলো পাখি ও কুমিরের খাদ্য। গবেষণার সময় তেল গায়ে লাগানো মাত্র দুটি কুমির দেখা গেছে। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় এ স্থানের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় তিন থেকে ছয়টি কুমির দেখা যায়। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে অবিলম্ভে বর্তমানের শ্যালা নদীর নৌরুটটি বাতিল ও কয়লা পরিবহন বন্ধের কথা বলা হয়েছে গবেষনায়। একই সাথে গবেষক দলটি আগামী এক বছর সুন্দরবনের ওপর গবেষণা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে।

(একে/এটিআর/জানুয়ারি ০৩, ২০১৫)