মাদারীপুর প্রতিনিধি : যৌতুকের দাবীতে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার চৌরাশি-বাজিতপুর গ্রামে লিভু বিশ্বাস নামের(১৮) এক গৃহবধুকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করেছে তার স্বামী রিপন মল্লিক। ঐ গৃহবধুর চুল কেটে শরীরের বিভিন্ন স্থানে গরম লোহার রড দিয়ে ছেকা দেয়া হয়। সে এখন মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন আছে।

স্থানীয়, পারিবারিক ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রাজৈরের চৌরাশি-বাজিতপুর গ্রামের রমেশ বিশ্বাসের মেয়ে লিভু বিশ্বাসকে প্রায় দেড় বছর আগে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার বৈকুন্ঠপুর গ্রামের নগেন মল্লিকের ছেলে রিপন মল্লিকের (২৫) সাথে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের পর থেকেই স্বামী রিপন মল্লিক, দেবর সবুজ মল্লিক ও শাশুরী ফুলমালা মিলে যৌতুকের দাবীতে নির্যাতন করতে থাকে। তিনমাস আগে লিভুর বাবা-মা তাকে শ্বশুরবাড়ী থেকে বাবার বাড়ি বেড়ানোর উদ্দেশ্যে আনতে গেলে মেয়েকে না দিয়ে উল্টো স্বামী, দেবর ও শ্বাশুরী মিলে তাদের মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। এক মাস আগে স্বামীসহ শশুরবাড়ির সবাই মিলে লিভুকে গরম লোহার রড দিয়ে হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেক দেয়। পরবর্তীতে মাথার চুল কেটে দেয় এবং বেদম মারপিট করে নির্জন স্থানে আটকে রাখে। এভাবে তারা ঐ গৃহবধুকে প্রতিনিয়ত নির্যাতন চালাতে থাকে। তাদের নির্যাতনে বর্তমানে লিভু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। তাছাড়া তার হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেক দেয়ায় ঐ স্থানগুলোতে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

এসব ঘটনা লিভুর শ্বশুরবাড়ি এলাকার গ্রাম্য চৌকিদার বাসু সেন তার বাবার বাড়ীতে জানায়। খবর পেয়ে লিভুর বাবার বাড়ির লোকজন তাকে আনতে গেলে স্বামীসহ শশুরবাড়ির লোকজন বাধা দেয়। পরবর্তীতে ঐ এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার লিভুকে উদ্ধার করে রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এ ব্যাপারে লিভুর মা লক্ষ্মী বিশ্বাস জানায়, দেড় বছর আগে আমার মেয়েকে ২ লাখ টাকা যৌতুক দিয়ে রিপনের সাথে বিয়ে দিই। বিয়ের পর থেকেই তারা মোটরসাইকেল ও টিভির জন্য চাপ দিতে থাকে। আমরা অপারগতা প্রকাশ করায় আমার মেয়ের উপর প্রায়ই নির্যাতন চালাত। আমরা ওদের বাড়ীতে গেলে আমাদেরও মারপিট করেছে। মেয়ের জামাই, দেবর ও শ্বাশুরী মিলে তাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলার চেষ্টা চালায়। খবর পেয়ে আমরা লিভুকে এনে রাজৈর হাসপাতালে ভর্তি করি। ভর্তির পর থেকেই সে হাসপাতালের বেডে সুয়ে কখনও হাসছে। কখনও কাদছে। কখনও উল্টো পাল্টা কথা বলেই যাচ্ছে। ওকে ওর শশুরবাড়ির লোকজন পাগল বানিয়ে দিয়েছে। আমরা এই অমানবিক নির্যাতনের বিচার চাই।

নির্যাতিত লিবু বিশ্বাসের ভাই রিপন বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ। বোনকে বিয়ে দিয়েছিলাম সুখের আশায়। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই আমার বোন জামাই রিপন মল্লিক বোনকে নির্যাতন করত। বৃহস্পতিবার নির্যাতনের সংবাদ শুনে গিয়ে দেখি আমার বোনের মরামরা অবস্থা। দিনের পর দিন এই অমানুসিক নির্যাতনে আমার বোন এখন পাগল হয়ে গেছে।’ বৈকুন্ঠপুর এলাকার গ্রাম্য চৌকিদার বাসু সেন জানান, মাঝে মাঝেই রিপনসহ তার পরিবারের লোকজন ঐ গৃহবধুর উপর নির্যাতন চালাত। এমনকি পানিতে চুবাতো। এ ঘটনা টের পেয়ে আমি তার বাবার বাড়ীতে খবর দিই। তারা এসে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার খোন্দকার নুসরাত জাহান জানান, রোগীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোড়ার ক্ষত রয়েছে। তাছাড়া তার মানসিক অনেক সমস্যাও দেখা দিয়েছে। বর্তমানে তার চিকিৎসা চলছে। রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. প্রদীপ চন্দ্র মন্ডল জানান, ‘গৃহবধু অমানুসিক নির্যাতনে এখন প্রায় মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে। চুলকাটা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গে লোহার রড দিয়ে ছেকা দেয়া দগ দগে ঘা হয়েছে। সুস্থ হতে দীর্ঘ মেয়াদী উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।’


মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার কণা জানান, ‘বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমরা নির্যাতিত পরিবারকে আইনি সহায়তা দেব।’ রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জানান, ‘বিষয়টি জেনে আমি কর্তৃপক্ষকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি।’

(এসিএ/পি/জানুয়ারি ০৩, ২০১৫)