ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি : রীনা বালা হালদার (৪৫) ও তার মেয়ে কামনা হালদার (২৫) দু’জনই বিধবা। পরিবারের আরেক সদস্য বাসনা হালদার (১৮) এর বিয়ে হলেও স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত । এখন আশ্রয় নিয়েছেন মা-বোনের সংসারে। এদের নিজস্ব বসত ভিটে নেই। পদ্মার ভাঙ্গনে তাদের ঘর-বাড়ি দুই বছর আগেই বিলীন হয়েছে। এখন অন্যের জমিতে ঘর তুলে কোন রকমে মাথা গোজার ঠাঁই করেছেন।

রীনা বালা বাড়িতে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না। প্রায় বছর খানেক হলো বড় মেয়ে কামনা হালদার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের কাজ নিয়েছে। তার রোজগারের আয় দিয়েই এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সংসার। ১৫ বছর আগে রীনা বালা স্বামী কার্তিক হালদার মারা যাওয়ার পর দুই মেয়ে কামনা ও বাসনাকে নিয়ে দরিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে খেয়ে না খেয়ে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটালেও বিধবা ভাতার কার্ড পাননি। একাধিকবার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে ধর্ণা দিয়েও পাননি সরকারি বিধবা ভাতা।

ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নের আরামবাড়িয়া হালদার পাড়ার রীনা বালা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, তিন সদস্যের পরিবারের মধ্যে দুইজনই বিধবা। আরেকজন স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত। অথচ আমরা কেউ বিধবা ভাতার কার্ড পেলাম না। তাহলে সরকার কার জন্য এই কার্ড দেয়- আমি বুঝি না।

একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজের কষ্টের কথা বললেন, ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়া ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের আকলিমা খাতুন (৬০) ও করিমা খাতুন (৫০) নামের দুই বিধবা নারী। আকলিমা খাতুন জানান, তার স্বামী মকলেছুর রহমান মারা যাওয়ার পর ৫ ছেলে-মেয়ের মধ্যে ৪ জন যার যার মতো সংসার পেতেছে। প্রতিবন্ধী এক ছেলেকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে অভাব অনটনে দিন কাটছে। একাধিকবার চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে অনুরোধ করেও বিধবা ভাতার কার্ড পাননি।


করিমা খাতুন জানান, তার স্বামী আবু বক্কার সিদ্দিক প্রায় ৯ বছর আগে মারা গেছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দিনমজুর দুই ছেলেও বিয়ে করে সংসার করছে। ছেলেদের অভাবের সংসারে তিনি থাকেন। বয়স হয়েছে অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। চিকিৎসা করার মতো কোন টাকা পয়সা নেই। ছেলেরা কষ্ট করে ভাত-কাপড় দিলেও চিকিৎসা খরচ দিতে পারে না। নিজের প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর জন্য বিধবা ভাতা পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি।

ঈশ্বরদীর সাতটি ইউনিয়নের বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত দুঃস্থ ও অসহায় ২০৫২ জন নারীকে ‘ বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা’র আওতায় আনা হয়েছে। প্রতিমাসে এদের ৩০০ টাকা করে ভাতা প্রদান করা হয়। ৩ মাস পর পর এই ভাতা তারা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেন। জানা গেছে, গত অর্থ বছরে (২০১৩-১৪) এই উপজেলায় বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা বাবদ ৭৩ লাখ ৮৭ হাজার ২০০ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে।

সাঁড়া ও দাশুড়িয়া ইউনিয়ন সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত মানুষের সংখ্যা অনুযায়ী এ দুইটি ইউনিয়নে এই ভাতা সুবিধাভোগীদের সংখ্যা অনেক কম। গ্রামের শত শত বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারীকে এই ভাতা সুবিধার আওতায় আনা যায়নি। ভাতার জন্য অনেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। কিন্তু জুটেনি ভাতার কার্ড। ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, সাঁড়া ইউনিয়নে ২৫৫ জন ও দাশুড়িয়া ইউনিয়নে ৩১০ জনকে বিধবা ভাতার আওতায় আনা হয়েছে।


বিধবা ভাতা না পেয়ে কেউ কেউ হতাশায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেও ভাতা পেয়ে আবার অনেকে বেশ খুশি হয়েছেন। সাঁড়া ইউনিয়নের আরামবাড়িয়া গ্রামের তাপসী হালদার (৬০) বলেন, ভাতার টাকা তিন মাস পর পর ঠিক মতোই পাওয়া যায়। ভাতার পরিমাণ বেশি হলে ভাল হতো। এখন এত কম টাকায় কিছু হয় না। সাঁড়া ইউপি চেয়ারম্যান জার্জিস হোসেন বলেন, ইতিপূর্বে এই ইউপিতে ২৩২ জন বিধবা ভাতার সুবিধা পেতেন। এই অর্থ বছরে ২৩ জন নতুন করে ভাতা সুবিধার আওতায় এসেছে। তবুও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। দাশুড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম কেনেডি জানান, বিধবা ভাতা নিয়ে আমরা মাঝে মধ্যে বিভ্রান্তিতে পড়ি। দেখা যায়, একজনকে বিধবা ভাতার কার্ড দিয়েছি, সে কিছুদিন পরেই আবার বিয়ে করে ফেলেছে। ফলে সে কার্ড বাতিল করতে হয়।

উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার আব্দুল কাদের বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারী সংখ্যা অনুযায়ী ভাতার কার্ডের পরিমাণ নগন্য স্বীকার করে বলেন, ইউনিয়ন বিধবা ভাতা যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই ভাতার অনুমোদন দেওয়া হয়। এই উপজেলায় ভাতার কার্ড নিয়ে দুর্নীতির কোন অভিযোগ নেই। সুষ্ঠুভাবে ভাতা কর্মসূচী পরিচালিত হচ্ছে।

(এসকেকে/এএস/জানুয়ারি ০৫, ২০১৫)