চৌধুরী আ. হান্নান : শুকুরের মা বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করার সময় একটি ছোট্ট পাত্র আমার মা এর কাছে রেখে যেত ভাতের মাড় সংগ্রহের জন্য। মা সেই পাত্রে মাড়ের সাথে দু-এক চামচ ভাত দিয়ে রাখত। দিনান্তে সে উঠানের এক প্রান্তে বসে সেই মাড় মিশ্রিত ভাত তৃপ্তির সাথে খাওয়ার পর যে হাসিটা দিত তা দেখার সৌভাগ্য অনেকেরই হয় না। এ দৃশ্য অতীতের।

আমাদের বাড়ি ফরিদপুরের এক পাড়া গায়ে, ভাঙ্গা উপজেলার ধর্মদী গ্রামে। বড় একটি বাড়িতে বলতে গেলে থাকার লোক নেই। সত্তরোর্ধ অবসরপ্রাপ্ত বড় ভাই ও ভাবী থাকেন। একটি ঘরে মেহেরুন তার স্বামী ও দু-সন্তান নিয়ে থাকে। ওরা বাড়ির দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করলেও অনেকটা একই পরিবারের মত। তাদের নিজের জমি নেই- নিজস্ব থাকার জায়গাও নেই।

মূলত শীতের পিঠা খেতে সপরিবারে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছি। এক সন্ধ্যায় ঘরোয়া আলোচনায় মেহরুন জানান- ‘কত অভাব ছিল ! কত খাবার কষ্ট করেছি ! একমুঠ ভাত পেট ভরার জন্য অনেক পানি মিশিয়ে কাঁচা মরিচ দিয়ে খেয়েছি।’ অভাব আতংক এখনও তার চোখে মুখে ! এখন সে পেট ভরে খেতে পারে। মনে হয় ওর কাছে ভাত খাওয়ার চেয়ে আনন্দ আর কিছু নেই। এ টিত্র বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামেরই চিত্র।

মহান সৃষ্টিকর্তা আবার বাংলাকে শষ্য ভাণ্ডারে পরিনত করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ বহু বছর খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। সরকারের সহায়তা ও কৃষক- দিনমজুরদের অক্লান্ত শ্রমে আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ এখন চাল রপ্তানি করে। এ বিষয়ে ‘সমকাল’ বলেছে-নতুন যুগে বাংলাদেশ (২৮ ডিসেম্বর, ১৪)

ষাটের দশকে আমরা স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ‘জীবনের লক্ষ্য’ নিয়ে রচনায় লিখতাম বড় হয়ে ডাক্তার হব, গ্রামে ফিরে এসে গরিব মানুষের সেবা করব। সবাই গ্রামের গরিব মানুষের সেবা করার কথা বলত। আমরা কিশোর বয়সে চর্তুদিকে মানুষ জনের কষ্ট, অভাব দেখে দেখে বড় হয়েছি। অনেকেই গাভীর দুধ, খেজুরের গুড় বিক্রি করে অন্যের জমিতে কাজ করে সন্তানের পড়ার খরচ জোগাত। সে কারণে গ্রামে ফিরে আসার কথা, তাদের সেবা করা কথা হয়ত মন থেকেই বলতাম। আমরা অনেকেই অনেক ‘কিছু’ হয়েছি কিন্তু গ্রামে আর ফিরে আসা হয়নি। শৈশব-কৈশরের যে গ্রাম সে গ্রামই রয়ে গেছে। আর আমরা গ্রামের অন্ধকার থেকে উঠে এসে শহরকে আলোকিত করে চলেছি-আমরা এখন শহরবাসী। কিন্তু শৈশব স্মৃতি আমাদের নিত্য তাড়া করে। পুকুর, খাল, বিলে এক সাথে মাছ ধরা, গাছের ঘুঘু পাখি শিকার করা। আষাঢ় মাসে আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটার সময় পুকুরের কৈ মাছগুলো দলবেঁধে ডাঙ্গায় উঠে আসার বিরল দৃশ্য শহরের মানুষ দেখবে কোথায়?

অবহেলিত গ্রাম অঞ্চলের সাথে শহরের সব দুরত্ব কমাতে, সেতুবন্ধন সৃষ্টি করতে সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন করা হয়েছে। চাকুরিজীবীরা সপ্তাহ শেষে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাতে শহরের শিক্ষিত ভদ্র লোকজন গ্রামে গিয়ে তাদের আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাবের আদান প্রদান করতে পারে। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সঠিক পরামর্শ পাবে তারা।


আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে গ্রামে। প্রতিটি পরিবারে রয়েছে মোবাইল ফোন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীদের সাথে ঘরে বসে স্বজনেরা কথা বলে নির্বিঘ্নে। সৌদি আরব, মালোয়েশিয়া এখন আর দূরের কোন দেশ নয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৯০ লক্ষের মত বাংলাদেশি নাগরিক নানা পেশায় নিয়োজিত। তারা বছরে ৬ হাজার কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতিতে যোগান দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পোষাক শিল্পের উত্থান বিস্ময়কর, বুকভরা আশা জাগানিয়া। প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিকের কর্ম সংস্থান হয়েছে সেখানে। তাদের অধিকাংশই আবার নারী শ্রমিক যারা এতদিন ছিল কর্মহীন অন্ত:পুরবাসিনী। তারা এবার শ্রমের মূল ধারায় যোগ হয়েছে।


আবার জনসংখ্যার সিংহভাগ কৃষিকাজ নিয়ে সারাবছর কর্মব্যস্ত। যুদ্ধ জয়ের বিজয়ী বীর তারা- খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা উপহার দিয়েছে আমাদের।

বাংলাদেশ অনন্য সুন্দর এক দেশ। মানুষগুলো কত কর্মঠ, সাধারণ আর কত অল্পে তুষ্ট, তা গ্রামে না এলে বুঝা যায় না। এখন কেবল দুর্বৃত্তের ‘কামড়’ থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করা এবং স্বল্প সংখ্যক দুর্নীতিবাজদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা চাই। তা হলে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ নয়, একটি উন্নত দেশে পরিনত হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

তিন দিন শৈশব-স্মৃতির মধ্যে ডুবে থেকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা ভোরে ঢাকার বাস ধরার জন্য স্ত্রী সন্তান নিয়ে অটোরিক্সায় উঠে বসলাম আর কানে বাজতে লাগল মেহরুনের গ্রাম্য সরল কথাটি-অল্প সময়ের জন্য আসলেন আর মায়া লাগায়ে গেলেন !

লেখক : সাবেক ব্যাংকার