গাজীপুর প্রতিনিধি : রাজধানীর উপকণ্ঠে শিল্প শহর টঙ্গীর ঐতিহাসিক কহর দরিয়ার (তুরাগের শাখা) তীরে শুক্রবার ফজরের নামায়ের পর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে তাবলীগ জামাতের ৫০তম বিশ্ব ইজতেমা। এবারও দুই ধাপে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ঢাকার উত্তরাঞ্চলের এবং দ্বিতীয় ধাপে ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মুসল্লিরা ইজতেমায় শরিক হচ্ছেন। রবিবার পূর্বাহ্নে প্রথম ধাপের আখেরী মোনাজাতের পর ৪ দিন বিরতি দিয়ে ১৬ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপে ইজতেমা। আগামী ১৮ জানুয়ারি রবিবার জোহরের আযানের আগে আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারে বিশ্ব ইজতেমা।

গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার (বর্তমানে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি) এস.এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামানের অনুরোধে তাবলীগ জামাত কর্তৃপক্ষ বিগত ২০১১ সাল থেকে দু’দফায় বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করে আসছে। এতে ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীতে মানুষের চাপ যেমন কমছে তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও দায়িত্ব পালন অনেকটা সহজতর হয়েছে।

এবারের দু’ধাপের ইজতেমার সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই সম্পন্ন্ করেছে তাবলীগ জামাত কর্তৃপক্ষ। সেই সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থা ইজতেমা আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কের সাথে ইজতেমা ময়দানের সংযোগ স্থাপন করতে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা তুরাগ নদীতে ৯টি ভাসমান সেতু স্থাপন করেছেন। ১৬০ একর জমির ওপর নির্মিত সুবিশাল প্যান্ডেলের কাজ, মুসল্লিদের এলাকা ভিত্তিক অবস্থানের সুবিধার্থে খুঁটিতে নম্বর প্লেট, খিত্তা নম্বর, জুড়নেওয়ালি জামাতের কামরা, তাশকিল কামরা, হালকা নম্বর বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ময়দানে সমবেত মুসল্লিদের সুষ্ঠুভাবে বয়ান শোনার জন্য পুরো মাঠে শব্দ প্রতিধ্বনি রোধক প্রায় ৩শ’ টি বিশেষ ছাতা মাইক স্থাপন করা হয়েছে।

এদিকে মরণঘাতী ইবোলা ভাইরাস আক্রান্ত ৫টি দেশ লাইবেরিয়া, গিনি, নাইজেরিয়া, মালি ও সিয়েরালিওনের নাগরিকদের স্ব-স্ব দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এছাড়াও যে সব দেশে জঙ্গী গোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে সেসব দেশের নাগরিকদের ইজতেমায় অংশগ্রহণে বিশেষ সতর্কতা রয়েছে। ইজতেমায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বৃহস্পতিবার পুলিশ ও র‌্যাবের নিয়ন্ত্রণ কে পৃথক ব্রিফিং হয়েছে। এতে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস.এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান এবং র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন।

প্রথম ধাপের ইজতেমায় এলাকা ভিত্তিক খিত্তাওয়ারী মুসল্লিদের অবস্থান : ইজতেমার প্রথম ধাপে ঢাকার উত্তর থেকে দেশের উত্তরভাগের মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করবেন। এর মধ্যে ১ থেকে ১২ নম্বর খিত্তায় গাজীপুর, ১৩নং খিত্তায় ঢাকা-৩ থেকে (ঢাকা-১,২ বাদে) ১২, ১৪নং খিত্তায় সিরাজগঞ্জ, ১৫নং খিত্তায় নরসিংদী, ১৬নং খিত্তায় ফরিদপুর, ১৭নং রাজবাড়ী, ১৮নং খিত্তায় শরিয়তপুর, ১৯(১-২) খিত্তায় কিশোরগঞ্জ, ২০নং খিত্তায় নাটোর, ২১নং খিত্তায় শেরপুর, ২২ নং খিত্তায় দিনাজপুর, ২৩নং খিত্তায় হবিগঞ্জ, ২৪নং খিত্তায় রংপুর, ২৫নং খিত্তায় লালমনিরহাট, ২৬নং খিত্তায় গাইবান্ধা, ২৭নং খিত্তায় জয়পুরহাট, ২৮নং রাজশাহী, ২৯নং খিত্তায় সিলেট, ৩০নং খিত্তায় চাঁদপুর, ৩১ নং খিত্তায় ফেনী, ৩২ নং খিত্তায় চট্টগ্রাম, ৩৩ নং খিত্তায় বান্দারবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ৩৪ নং খিত্তায় বাগেরহাট, ৩৫ নং খিত্তায় নড়াইল, ৩৬ নং খিত্তায় চুয়াডাঙ্গা, ৩৭ নং খিত্তায় যশোর, ৩৮ নং খিত্তায় ভোলা, ৩৯ নং খিত্তায় বরগুনা ও ৪০ নং খিত্তায় ঝালকাঠি জেলার মুসলিরা অব¯'ান করবেন। এদিকে মুসল্লিদের সুবিধার্থে ময়দানের উত্তর দিক থেকে ক্রমানুসারে দণি দিকে খিত্তার নম্বর বসানো হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমায় খিত্তাওয়ারী মুসল্লিদের অব¯'ান : ১ ও ২ নম্বর খিত্তায় নারায়ণগঞ্জ, খিত্তা নং-৩ (ঢাকা-১, হালকা-৩০১-৩২৫), খিত্তা নং-৪ (ঢাকা-২, হালকা-৬০১-৬৩৯), খিত্তা নং-৫ (কক্সবাজার), খিত্তা নং-৬ (মানিকগঞ্জ), খিত্তা নং-৭ (পিরোজপুর), খিত্তা নং-৮ (পটুয়াখালী), খিত্তা নং ৯(১) (টাঙ্গাইল-ক), খিত্তা নং ৯(২) (টাঙ্গাইল-খ), খিত্তা নং-১০(১) (জামালপুর-ক), খিত্তা নং-১০(২) (জামালপুর-খ), খিত্তা নং-১১ (বরিশাল), খিত্তা নং ১২(নেত্রকোনা), খিত্তা নং-১৩ (কুমিল্লা), খিত্তা নং-১৪(মেহেরপুর), খিত্তা নং-১৫ (ঝিনাইদহ), খিত্তা নং-১৬ (ময়মনসিংহ-১), খিত্তা নং-১৭ (ময়মনসিংহ-২), খিত্তা নং-১৮ (ময়মনসিংহ-৩), খিত্তা নং-১৯ (লক্ষ্মীপুর), খিত্তা নং-২০ (বি-বাড়িয়া), খিত্তা নং-২১(কুড়িগ্রাম), খিত্তা নং-২২ (নোয়াখালী), খিত্তা নং-২৩ (নীলফামারি), খিত্তা নং-২৪ (ঠাকুরগাঁও), খিত্তা নং-২৫(পঞ্চগড়), খিত্তা নং-২৬ (চাপাইনবাবগঞ্জ), খিত্তা নং-২৭ (বগুড়া), খিত্তা নং-২৮ (পাবনা), খিত্তা নং-২৯ (নওগাঁ), খিত্তা নং-৩০ (মুন্সিগঞ্জ-১), খিত্তা নং-৩১ (মুন্সিগঞ্জ-২), খিত্তা নং-৩২ (মাদারীপুর), খিত্তা নং-৩৩ (গোপালগঞ্জ), খিত্তা নং-৩৪ (সাতীরা), খিত্তা নং-৩৫ (মাগুরা), খিত্তা নং-৩৬ (খুলনা), খিত্তা নং-৩৭ (সুনামগঞ্জ), খিত্তা নং-৩৮ (মৌলভী বাজার), ৩৯ (কুষ্টিয়া)।

যে সব দেশের মুসল্লিদের ইজতেমায় আসতে বিশেষ সতর্কতা : জঙ্গী তৎপরতার আশংকায় এবারের বিশ্ব ইজতেমায় প্রথম বারের মতো মুসলিম বিশ্বের অন্তত: ১০টি দেশের নাগরিকদের ময়দানে আসা - যাওয়ার ভিসার ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা আরোপ করেছে বাংলাদেশ সরকার। দেশগুলো হলো- পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, সুদান, সিরিয়া, জর্ডান, মিশর ও ইয়েমেন।

আইনশৃঙ্খলা জোরদার : গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর-রশিদ জানান, ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ইজতেমার আগে, ইজতেমা চলাকালীন সময়, দুই ধাপের মাঝে ও ইজতেমা শেষে ১৮ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পাঁচ সেক্টরে বিভক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করবে। ইজতেমা চলাকালীন সময় ময়দানের চর্তুদিকে থাকছে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয়। সেই সাথে থাকছে স্টাইকিং ফোর্স, চেক পোস্ট, ওয়াচ টাওয়ার এবং ইন্টারনেটের ওয়াইফাই সুবিধাসহ মিডিয়া সেন্টার।

ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের গাড়ি পার্কিং : বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের যানবাহন পার্কিংয়ের জন্য স্থান নির্ধারণ করেছে ট্রাফিক বিভাগ: ঢাকা মহানগর এলাকা- (১) সাধারণ পার্কিং-১: উত্তরা রাজউক কলেজের আশেপাশে এবং ৬ ও ৭ নং সেক্টর, (২) সিলেট বিভাগ পার্কিং : উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর, (৩) বরিশাল বিভাগ-ধউর ব্রীজ ক্রসিং সংলগ্ন পার্কিং (আশা বিশ্ব বিদ্যালয়ের খালি জায়গা) (৪) ঢাকা বিভাগ পার্কিং- উত্তরা সোনারগাও জনপথ সড়কের পূর্ব হতে পশ্চিম মাথা, (৫) খুলনা বিভাগ পার্কিং-উত্তরা ১০ ও ১১নং সেক্টরের সড়কের উভয়পাশে, (৬) রংপুর বিভাগ- প্রত্যাশা হাউজিং, (৭) চট্টগ্রাম বিভাগ- গাউসুল আজম এভিনিউ (১৩নং সেক্টর রোডের পূর্ব প্রান্ত- হতে পশ্চিম প্রান্ত- হয়ে গরীবে নেওয়াজ রোড), (৮) রাজশাহী বিভাগ পার্কিং- কামারপাড়া হাউজিং মাঠ ও উত্তরা ১০নং সেক্টরের খালি জায়গা। ঢাকা জেলা- আশুলিয়া কলেজ মাঠ ও আশুলিয়া হাইস্কুল মাঠ। গাজীপুর জেলা (১) টঙ্গীর কে-২/নেভি সিগারেট ফ্যাক্টরির পাশে, (২) কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস গেট গ্যাপ ও পূর্ব পাশের ফাকা জায়গায়, (৩) কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিল প্রাঙ্গণ, (৪) মেঘনা টেক্সটাইল মিল সংলগ্ন রা¯-ার উভয় পাশে, (৫) সফিউদ্দিন সরকার একাডেমী মাঠ, (৬) সফিউদ্দিন সরকার মাঠের উত্তরপাশে টিআইসি মাঠ, (৭) জয়দেবপুর- চৌরা¯-া ট্রাকস্ট্যান্ড, (৮) চান্দনা-হাইস্কুল মাঠ ও (৯) ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠ।

চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম : ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে ব্যাপক প্রস্তুতি হাতে নেয়া হয়েছে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা: মাহবুবুর রহমান জানান, ‘গাজীপুর সিভিল সার্জন টঙ্গী ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালকে ইজতেমার জন্য অস্থায়ীভাবে ১০০ শয্যায় উন্নীত করেছেন। সেই সঙ্গে মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য ১টি নিয়ন্ত্রণ ক, ১টি হৃদরোগ ইউনিট, ১টি বব্যাধি/ এ্যাজমা ইউনিট, ১টি ট্রমা (অর্থোপেডিক) ইউনিট, ১টি বার্ণ ইউনিট, ১২টি স্যানিটেশন টিম এবং ১২টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়াও চু, বার্ণ, মেডিসিন ও সার্জারিসহ বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞসহ ৬০ থেকে ৭০ জন চিকিৎসক সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রয়েছে। ইবনে সিনা ও হামদর্দসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ফি" চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করেছে। ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে মন্নু টেক্্রটাইল মিলের মাঠে এধরণের অর্ধ শতাধিক চিকিৎসা কেন্দ্র চালু হয়েছে।

(এসএএস/অ/জানুয়ারি ০৮, ২০১৫)