চাঁদপুর প্রতিনিধি : ইয়াবা ও প্যাথেড্রিন ইনজেকশন নেশায় ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চাঁদপুরের যুব সমাজ। গাঁজা, মদ ও ফেনসিডিল এবং দেশী বিভিন্ন কাশের সিরাপে আসক্ত অনেকে। ঘুমের ট্যাবলেট সাথে থাকা চাই। শান্তির শহর নামে খ্যাত চাঁদপুরে মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন কারো পরিবারের সন্তানই মাদকের ছোবল থেকে নিরাপদ নয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবে এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা-কর্মী নানা হতাশায় মাদকের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় মাদক বিক্রি এবং পাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাঁদপুরে এখন সবচেয়ে বেশি সেবন হয় ইয়াবা। ইয়াবার বিষে আক্রান্ত কিশোর-তরুণ, যুবক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষ। চাঁদপুরে ব্যাপকহারে ইয়াবা ঢুকে পড়েছে। এর পাইকারি চালানদাতারা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শহরে-গ্রামে-গঞ্জেও হচ্ছে ইয়াবা সেবন এবং বিক্রিও হচ্ছে। সোমবার রাতে চাঁদপুর গোয়েন্দা পুলিশ সাহসিক এক অভিযান চালিয়ে অনেকগুলো ইয়াবাসহ ৩ জনকে আটক করতে সক্ষম হয়। আটক তিনজন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসন মাদক নির্মূলে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। এছাড়া শনিবার রাতে পুরাণবাজার ফাঁড়ি পুলিশ ৪০ পিচ ইয়াবাসহ একজন সিএনজি স্কুটার চালককে আটক করে। মাদক পাচারের কাজে এখন সিএনজি স্কুটার চালকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। বাবুরহাট থেকে চাঁদপুর শহর এলাকায় ইয়াবার চালান সরবরাহ করার সময় কোহিনুর সিনেমা হলের সম্মুখ থেকে আল-আমিন নামে সিএনজি স্কুটার চালককে আটক করা হয়। কিন্তু মূল হোতা ইয়াবা ব্যবসায়ীরা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এখনো যেসব স্পটগুলোতে মাদক বিক্রি হচ্ছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে সাঁড়াশি অভিযান চালানো অপরিহার্য বলে সচেতন মহল মনে করছেন। প্রশাসনের সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতাও বাড়ানো উচিত। যুবসমাজ রক্ষায় রাজনৈতিক নেতাদেরও সদিচ্ছা থাকা দরকার। ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে প্রতিটি পরিবারকে তাদের সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত থাকতে হচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এখন শহরে এমনকি গ্রামে-গঞ্জে রাত জেগে তরুণদের বেশ আনাগোনা। হাল ফ্যাশান হিসেবে তাদের আবার রয়েছে নতুন নতুন মডেলের মোটর সাইকেল। কে ভালো কে মন্দ বুঝার উপায় নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের বালিয়াবাজার এলাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ ইয়াবার পাইকারি চালান হচ্ছে। বিগত দিনে প্রশাসনের অভিযানে সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাও আটক হয়েছিলো। বোরকা রিপন ও শুক্কুর নামে দু’জন সেখানে ইয়াবার ডিলার। ওয়ারল্যাস এলাকার পল্ট্রি সুমন নামে একজন ইয়াবার পাইকারি ডিলার। চেয়ারম্যান ঘাট, কোর্ট প্রাঙ্গণ এলাকাসহ শহরের নতুন বাজারে ক’টি মাদক স্পট রয়েছে এবং পাইকারি চালানও হয়। বড় স্টেশন, রেলওয়ে এলাকা, নাজির পাড়া, প্রফেসর পাড়া, গুয়াখোলা, নতুন বাজার, পালপাড়া, আদালত পাড়া, বাসস্টেশন, ব্যাংক কলোনী, হাজী মহসিন রোড, হাসান আলী স্কুল এলাকা, বাবুরহাটসহ আরো অনেক জায়গায় ভাসমান মাদক বিক্রি হচ্ছে। পুরাণবাজার কোহিনুর সিনেমা হলের বিপরীত একটি পরিবারের একাধিক সদস্য প্রকাশ্যে ঘরে বসেই ইয়াবা ও ফেনসিডিল বিক্রি করছে। ওয়ার্ড নেতার পরিচয়ে জনৈক ব্যক্তি এলাকায় থেকে তাদের ভাইদের মাদক বিক্রিতে মদদ দিচ্ছে বলেও এলাকাবাসীর অভিযোগ। মধ্য শ্রীরামদী বউ বাজার এলাকায় রাশেদা বেগম ও তার ছেলে সোহেল প্যাথেড্রিন ইনজেকশন প্যানা, এভিলসহ নেশার সুই বিক্রি করছে। আইলার বিলে চান্দু খাঁর ছেলে রহমান ও শাহাজাহান চৌধুরীর ছেলে মিজান রহমান বাবু কক্সবাজার এলাকা থেকে ইয়াবার চালান এনে পুরাণবাজারের ক’জন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে সরবরাহ করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা মলম পার্টির সদস্য বলেও একটি সূত্র জানায়। পেট কাটা হাসেমের ছেলে মিন্টু কুমিল্লা সীমান্ত এলাকা থেকে প্যাথেড্রিন ইনজেকশন বহন করে তাদের কাছে সরবরাহ করছে বলে একটি সূত্রে জানায়। মিন্টুর বিরুদ্ধে দুটি নেশার ইনজেকশন মাদকের মামলা রয়েছে। তারা ছাড়াও আরো কয়েকজন নেশার ইনজেকশন বিক্রি করছে বলে জানা যায়।

উল্লেখ্য, এই নেশার ইনজেকশন প্যাথেড্রিন আসক্ত এমদাদ ছৈয়াল (৪০) নামে এক ব্যক্তি গত কয়েকদিন আগে মৃত্যুবরণ করে। এ নিয়ে চাঁদপুর শহর এলাকায় প্রায় ৩০-৩৫টি তাজা যুবকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ঘাতক মাদক নেশা প্যাথেড্রিন ইনজেকশনে। এখনো অনেকে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে শহরে বিচরণ করছে। মধ্য শ্রীরামদী বউ বাজার এলাকায় গাঁজা শুক্কুরের স্ত্রী সাজুদা বেগম, মধুসুদন স্কুল মাঠ দক্ষিণ কোনা, ঘোষপাড়া বালুরমাঠ সিলেটি ফারুক, পশ্চিম শ্রীরামদীর জসিম গাজী, মেরকাটিজ রোড টিপু দেওয়ানের বাড়ির ভাড়াটিয়া হোমিও লিটন ও তার স্ত্রী ইয়াবা বিক্রি করছে। অভিযোগ উঠেছে সুমন নামে কমিউনিটি পুলিশের এক সদস্য কৌশলে ইয়াবা পাইকারি ব্যবসা ও সরবরাহের সাথে জড়িত। ওসমানিয়া মাদ্রাসার পেছনে রিজির মার ভাড়াটিয়ার ঘর থেকে ফাঁড়ি পুলিশ ইন্ডিয়ান কয়েক বোতল মদ উদ্ধার করলেও এর সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার না করায় এলাকায় প্রশ্ন উঠেছে। এখানেও একটি পরিবার ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করছে। মেরকাটিজ রোড এলাকার বড় মুনছুরের গ্রামের বাড়িতে ফেনসিডিলের স্টক রয়েছে বলে জানা যায়। মাদক পাচার, সরবরাহ এবং সেবন এ তিনটির সাথেই জড়িত পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে বাড়ি কাজী টিপু। পুরাণবাজার গার্লস স্কুল মাঠের পাশে একটি বাড়িতে মাদক বিক্রি হয়। দক্ষিণ বাজার এলাকায় উজ্জ্বল-সজল নামে দু’ ভাই ভাসমান ইয়াবা বিক্রেতা বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। মোবাইল যোগাযোগের মাধ্যমে ইয়াবা বিক্রি ও সরবরাহ চলছে। ইয়াবা সেবনে মাদকসেবীদের অনিদ্রায় থাকতে হয়। তাই তাদের ঘুমের জন্য প্রয়োজন গাঁজার। চিহ্নিত মাদক স্পটগুলোতে থেমে নেই গাঁজা বিক্রি। পাশাপাশি বাংলা মদের কাউন্টারে সব সময় খোলা রেখে মদ বিক্রি হচ্ছে। যার নামে মদের লাইসেন্স তাদের কেউ মদ বিক্রি করছে না। সাব-লিজ নিয়ে জনৈক ব্যক্তি দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলা মদ বিক্রি করায় এলাকার পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে। মাদকসেবীর সংখ্যাও বাড়ছে। পুরাণবাজারের দুধহাটা বস্তি, মধ্য শ্রীরামদী কবরস্থান, বউবাজার, মেয়র সড়কে ৫-৭টি গাঁজা বিক্রির স্পট রয়েছে। আরেকটি সূত্র জানায়, রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়স্বজন অনেকে এমনকি ছাত্র ও যুবনেতাদের অনেকে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। চাঁদপুর জেলা শহরের বাইরে উপজেলা সদর ও পৌর এলাকা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় গ্রামেও ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা বিক্রি এবং সেবন থেমে নেই। মাদক নির্মূলে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রশাসন তেমন সোচ্চার ভূমিকা নিতে পারছে না। চাঁদপুরের যুব সমাজকে বিপদগামীতার হাত থেকে রক্ষা করতে প্রশাসনের সাথে সমাজের সকল শ্রেণির পেশার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের আরো সোচ্চার হবার প্রয়োজন বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। প্রশাসনের একার পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে এলাকায় প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ থাকতে হবে। এমন মতামত অনেকের।

(এমজে/অ/মে ০৬, ২০১৪)