কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : গত দু’দিন ধরে কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে আসছে হাজার হাজার জেলিফিস। সাগরে জোয়ারের স্রোতে এগুলো এসে ভাটার টানে বালুচরে আটকা পড়ছে। বালুচরে আটকা পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই জেলিফিসগুলো মরে যাচ্ছে। এদিকে হঠাৎ করে কুয়াকাটা সৈকতে জেলিফিস আটকা পড়ার খবরে উদ্বিগ্ন সাগরে মাছ শিকাররত জেলেরা। তাদের জালেও এ জেলিফিস আটকা পড়ছে।

প্রাথমিকভাবে জেলেরা এগুলো সাগরে ভেসে আসা জেলির মতো অনেকটা স্বচ্ছ লোড (গাম) জাতীয় বস্তু মনে করলেও এগুলো সামুদ্রিক প্রাণী জানার পর তারাও উদ্বিগ্ন। তবে স্থানীয়রা বলছেন সুন্দরবনের শ্যালো নদীতে তেল বোঝাই জাহাজডুবির কারণে পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে এ মাছগুলো কুয়াকাটা সংলগ্ন সমুদ্রে এসে দিক ভুল করে বালুচরে আটকা পড়ছে। এদিকে বালুচরে জেলিফিস আটকে পড়ার সংবাদ শুনে হাজার হাজার পর্যটক এ মাছ দেখতে সৈকতে ভীড় করছে। মূল সৈকতের চার/পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জেলিফিশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আটকে থাকায় পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র।

শুক্রবার বিকালে কুয়াকাটা সৈকত ঘুরে দেখাযায় বিস্তীর্ণ সৈকতের সর্বত্রই জেলিফিস মরে পড়ে আছে। প্রাথমিকভাবে পর্যটকরা এগুলো আঁঠালো মাটি বা বালুর দলা মনে করলেও পরবর্তীতে জেলিফিস দেখে তারাও উদ্বিগ্ন। হঠাৎ করে জোয়ারের টানে সামুদ্রিক প্রাণীগুলো সৈকতের বালুচরে আটকে পড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা মরে যাচ্ছে। অনেক পর্যটক এগুলো পা দিয়ে পিসে মেরে ফেলছে। তবে এগুলোতে এক ধরনের বিষ থাকে তা জানে না কেউই। এ কারণে জরুরী ভিত্তিতে এগুলো সৈকত থেকে অপসারণ না করলে খালি পায়ে এ বিষাক্ত জেলিফিস কারো পায়ে লাগলে তার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।



জানা যায়, পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রাচীনতম প্রাণীদের মধ্যে জেলিফিস একটি। এরা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি বছর আগ থেকে পৃথিবীতে রয়েছে। ঠাণ্ডা ও গভীর পানিতে জেলিফিস থাকে। এরা ঘুর্ণনের মাধ্যমে চলাচল করে। জেলিফিস নিজের শরীর থেকে উজ্জল আলো বিচ্ছুরণ করতে পারায় এরা সমুদ্রের তলদেশে নিজেদের সহজেই লুকিয়ে রাখতে পারে। প্রতিকূল পরিবেশে এরা টিকে থাকতে পারে এবং নিজের শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে রাখে। জেলিফিসে রয়েছে ভয়ংকর প্রাণঘাতী বিষ এমনকি এরা পারমানবিক শক্তিও বন্ধ করে দিতে পারে। জেলিফিস সমুদ্রের মাঝে ঘুরে বেড়ানো ছাতা আকৃতির প্রাণী, যারা অনেকটা প্রজাপতির মত নানান রঙে রঙিন।

সাগরের জেলিফিস অতি বিষাক্ত প্রাণী। এদের শরীরের নীচের দিকে অনেকগুলি আঁঠালো শুঁড় আছে যাকে ট্যান্ট্যকল বলে। এই ট্যান্ট্যকলের গায়ে থাকে কাঁটা যা শিকারের দেহে ঢুকিয়ে দেয়। এই কাঁটার কোষগুলি বিষাক্ত গ্রন্থির সাথে সংযুক্ত। কাঁটাগুলির অগ্রভাগ সুক্ষ সুঁই এর মতো। এই সুঁই দিয়ে সে নিজেকে রক্ষা করে। জেলিফিস আকারে অনেক বড় হয়। একটি জেলিফিস কোন মানুষকে জড়িয়ে ধরলে সে প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে। তবে কুয়াকাটা সৈকতে আটকা পড়া জেলিফিসগুলো ২/৩ ফুট লম্বা ও ওজনে প্রায় ১০ কেজি বলে জেলেরা জানান।

কুয়াকাটায় ভ্রমণে আসা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্র অমিত বসু জানান, তাদের ধারনা সাগরে তলদেশ উত্তপ্ত হওয়ার কারণে ঠাণ্ডা পরিবেশ খুঁজতে এগুলো ঝাঁক বেঁধে কুয়াকাটায় এসে দিকভুল করে বালুচরে আটকা পড়েছে। কেননা জেলিফিস সবসময় ঝাঁক বেঁধে সমুদ্রে চলাচল করে। তবে বালুচরে আটকা পড়ার ২০/৩০ মিনিট পর্যন্ত এরা বেঁচে থাকে। এদের রয়েছে নিজেদের বেঁচে থাকার শক্তি সঞ্চয়ের অদ্ভূত ক্ষমতা।
জানা যায়, ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে কুয়াকাটা সৈকতের বালুচরে এভাবে প্রচুর জেলিফিস আটকা পড়ে মারা যায়। প্রায় একসপ্তাহ ধরে এভাবে কয়েক লাখ জেলিফিস মারা যায়। পরবর্তীতে এগুলো সৈকত থেকে অপসারণ করা হয়েছিলো। কিন্তু গত দু’দিন ধরে সৈকতে আবার জেলিফিস আটকা পড়ে মরে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন কুয়াকাটার সবশ্রেণীর মানুষ।



জেলিফিস আটকা পড়ার সংবাদশুনে কুয়াকাটায় ভ্রমণে আসা পর্যটক বশিরুল ইসলাম জানান, এগুলো দেখতে তিনি কুয়াকাটা এসেছেন। তার ভাষায় প্রতিটি জেলিফিসই জীবন্ত। অনেকটা আঠালো অবস্থায় বালুচরে মাংসপিণ্ডের মতো পড়ে আছে। তিনি হাত দিয়ে ধরে দেখে বুঝেছেন বালুতে আটকা পড়ার কিছুক্ষন পর পর্যন্তও এরা জীবিত থাকে। জলবায়ূর দ্রুত পরিবর্তনজনিত কারণে জেলিফিশের অভয়াশ্রম বাস অনুপযোগী হওয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে পারে এমন হয়েছে বলে পর্যটকরা ও বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা।

সাগরে মাছ শিকাররত এফবি মনোয়ারা ট্রলারের জেলে আলমগীর হোসেন জানান, সাগরে জাল পাতলে এখন শুধুই জেলিফিস ধরা পড়ছে। তিন/চারদিন ধরে এমন অবস্থা চলছে। তবে আগের চেয়ে কমেছে। জেলে সেকান্দার গাজী জানান, তিন-চার দিন সাগরে (ফাইস্যা-ফ্যাহা) জেলিফিসের কারণে জাল ফেলতে পারছেন না। তাদের ভাষায় এগুলো সাগরের নোনা বা আঠার দলা।

কুয়াকাটায় ভ্রমণে আসা পর্যটক নিমতি, মাহমুদা জানান, সাগর পারে আটকে থাকা জেলিফিস শুকিয়ে বীচে পর্যটকের হাঁটাচলা করতে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। জেলিফিসের কারণে পর্যটকরা সাগরে গোসল করতে নামতে সাহস পাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব-বিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. আ.ক.ম মোস্তফা জামান সাংবাদিকদের জানান, সমুদ্রে দূষণের কারণে জেলিফিসের অভয়াশ্রম বাস অনুপযোগী হয়ে এমন বিপর্যয় হতে পারে। ভেসে আসা জেলিফিসটির বৈজ্ঞানিক নাম অরিলিয়া-অরিটিয়া।

কুয়াকাটা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই সঞ্জয় মণ্ডল জানান, তারাও গত দু’দিন ধরে এ অবস্থা দেখছেন। সাগর পাড়ে আটকা পড়া জেলিফিসগুলো বিষাক্ত কিনা তা তারা জানেন না। বিষয়টি মৎস্যবিভাগসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

(এমকেআর/এএস/জানুয়ারি ১১, ২০১৫)