ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি : চকচক করলেই যেমন সোনা হয় না। তেমনি চকচক করলেই চাল ভাল হয় না। কাটিং ও পালিশ করা চিকন চকচকে ভেজাল চাল হরহামেশা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এই প্রতারণা বন্ধে কোন উদ্যোগ নেই। ফলে ভেজালকারী চাল ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম ক্রমশ বাড়ছে। এরা আঙ্গুল ফুলে রাতারাতি কলাগাছ হলেও প্রতারিত হচ্ছে  মানুষ। তাছাড়া শরীরে ক্যান্সার প্রতিষেধক কার্বোহাইড্রেড প্রাপ্তি হতেও বঞ্চিত হচ্ছে ভোক্তারা ।

জানা যায়, বাজারে মিনিকেট বলে পালিশ ও কাটিং করা চিকন যে চাল বিক্রি হয় তার বেশীরভাগই ভেজাল। ভূক্তভোগী ক্রেতারা জানান, এই চালের ভাত খেয়ে কোন স্বাদতো পাওয়া যায়ই না, বেশিদিন ঘরে রাখলে চাল নষ্ট হয়ে যায়। এই নিয়ে প্রায়ই বিক্রেতাদের সাথে ক্রেতাদের কথা কাটাকাটি হতে দেখা যায়। বিক্রেতারা জানান, আমরা মোকাম থেকে চাল কিনে এনে বিক্রি করি। স্বাদ আছে কিনা এবং বেশিদিন ঘরে থাকবে কিনা আমাদের জানা নেই। বিষয়টি অনুসন্ধান করতে যেয়ে জানা যায়, বিগত ৩-৪ বছরে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম চালের মোকাম ঈশ্বরদীতে প্রায় ১৫টি চালের হুইট প্রসেস মিল বসেছে।

এছাড়া নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়ার খাঁজানগরসহ দেশের আরো কয়েকটি মোকাম এলাকায়ও প্রসেস মিলে চাল চিকন ও পালিশ করা হচ্ছে জানা গেছে। সূত্র জানায়, অধিক লাভের আশায় এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মিনিকেট চালের সাথে ইরি বিআর-৫, বিণা-৭, বিআর-২৮, বিআর-২৯ চাল মিশিয়ে প্রসেস মিলে চাল ঘষে চিকন ও পালিশ করে বেশি দামে বাজারজাত করছে। মিলগুলো বসাতে খরচ পড়ে ২৫-৩০ লাখ টাকা। ভারত, কোরিয়া এবং চীন হতে এই মিল আমদানি করা হয়েছে বলে জানা যায়। কোন কোন ব্যাংকও মিল বসাতে ঋণ দিয়েও অর্থায়ন করেছে। প্রসেস মিলে প্রথমে চাল নেটিং করে খুদ, ময়লা ও মরা চাল পৃথক করা হয়। পরে চাল পানি দিয়ে ধুয়ে হুইটারে ঘষে চিকন ও পিচ্ছিল করা হয়। পিচ্ছিল ও চিকন করার সময় চালের উপরের আস্তরণ উঠে যায়। এই আস্তরণে কার্বোহাইড্রেড থাকে বলে জানা গেছে। পুষ্টবিদদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, চালের পুষ্টির মূল উৎসই উপরের আস্তরণ। এতে কার্বোহাইড্রেড থাকে। যা মানব দেহে ক্যানসার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।

জয়নগর মোকামের জনৈক চাল কল মালিক জানান, তিনি ৭,৬৪৪ কেজি চাল প্রসেস মিলে দিয়েছিলেন। প্রসেস করার পর তিনি ৭,১৩৪ কেজি চাল, ২০৩ কেজি সাদা খুদ, ১০৫ কেজি কালো খুদ, ৩৬ কেজি মরা চাল, ৫ কেজি ময়লা এবং ২০৭ কেজি পালিশ পেয়েছেন। অর্থাৎ ৭,৬৪৪ কেজি চাল দিলেও তিনি সবমিলিয়ে পেয়েছেন ৭,৬৯০ কেজি । প্রসেস করার সময় পানির কারণে বাড়তি হয় বলে জানা গেছে। পানির কারণে মশ্চারাইজার থাকায় বেশি দিন চাল ঘরে থাকলে নষ্ট হয়।

চালের পালিশ রাইস ব্রাণ ওয়েল মিলে এবং অন্যান্য উপকরণ পশু খাদ্য হিসেবে চড়া দামে বিক্রি হয়। অর্থাৎ চাল প্রসেস করার পর ঘাটতি তো হয়ই না উপোরন্ত বেশি পাওয়া যায় এবং উপজাত দ্রব্যও বেশি দাম বিক্রি হয়। চাল প্রসেস করতে কেজিতে .৯০ পয়সা খরচ দিতে হয়। ঈশ্বরদীর জয়নগর পাইকারী মোকামে মিনিকেট প্রতি কেজি ৪২-৪৩ টাকা, বিআর-৫ চাল ৩১ টাকা এবং বিণা-৭ চাল ৩২-৩৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা যায়। অর্থাৎ মিনিকেট চালের সাথে কমদামের চালের দামের পার্থক্য কেজিতে ১০ থেকে ১১ টাকা। সূত্র জানায়, সকল খরচ-খরচা বাদ দিয়ে গড়ে কেজিতে ৮-৯ টাকা লাভ হয়। হিসেব করলে দেখা যায়, শুধু বিনা-৭ চাল প্রসেস করার পর ৮৪ কেজি ওজনের ১৫০ বস্তার এক ট্রাক চাল বিক্রি করলে লক্ষাধিক টাকা অতিরিক্ত লাভ হয়। তবে মিনিকেটের সাথে মিশ্রণ করলে লাভের পরিমান কম হয়।

এই বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জনের আশায় কেউ কেউ ব্যবসা পরিবর্তন করে নেমে পড়েছে চালের ব্যবসায়। প্রসেস মিলগুলো শুধু অন্যের চালই প্রসেস করছে না। নিজেরাও চালকল হতে চাল কিনে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধেই ব্যবসায়ীদের অনেকেই রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। ভেজাল মিশ্রিত চিকন পালিশ করা এই চাল খেয়ে প্রতারিত ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ । পাশাপাশি চালে পুষ্টির মূল উপাদান কার্বোহাইড্রেডসহ অন্যান্য পুষ্টি প্রাপ্তি হতেও বঞ্চিত হচ্ছে। এই বিষয় প্রতিরোধে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহন না করা হলে সাধারণ মানুষের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং দেশের মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে।

(এসকেকে/এএস/জানুয়ারি ১৫, ২০১৫)