চৌধুরী আ. হান্নান : অফিস পিয়নের কাজ কী ? এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে এটা ওটা আনা নেয়া করা। বাহির থেকে চা বিস্কুট নিয়ে আসা, কর্মকর্তাদের নানা ফরমাশ খাটা। আবার অফিসে যদি কোন ‘বড় সাহেব’ থাকেন তার ব্যক্তিগত কাজ ও মাঝে মাঝে পিয়নকে দিয়ে করানো হয়। সেখানে কিছু বাড়তি প্রাপ্তি ও হয়ে থাকে। গ্রাহকদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে দু-দশ টাকা বকশিশ পেলেই পিয়ন খুশি। দিনান্তে যখন দেখা যাবে সে টুলে বসে পান চিবাচ্ছে, বুঝতে হবে দিনের রোজগারটা ভালই হয়েছে তার।

আমাদের আজকের ‘নায়ক’ রূপালী ব্যাংকের পিয়ন আবুল কালাম আজাদ। সে ফরিদপুর রূপালী ব্যাংক করপোরেট শাখা থেকে দেড় কোটি টাকার ও অধিক চুরি করে গত সপ্তাহে বাড়িতে নিয়ে গেল। এ চুরির ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে অনেকে মনে করে থাকবেন। কিন্তু ঘটনাটি সরকারি ব্যাংকের বর্তমান চিত্রের প্রতি কিছুটা হলেও ইঙ্গিত বহন করে। কারণ ব্যাংকিং ক্ষেত্রে বর্তমানে কেবল চোরের উপদ্রবই বাড়েনি, ডাকাতের কবলেও পড়েছে ব্যাংক।

ব্যাংকের একটি করপোরেট শাখায় যেখানে কেবল নিজ শাখার শত শত কোটি টাকা, স্বর্ণ, মূল্যবান দলিল পত্রই থাকে না, অন্যান্য শাখার ও অর্থ, সম্পদ জমা রাখা হয়, এমন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখার ভোল্টের চাবি কীভাবে পিয়নের হাতে পড়ল? পত্রিকার খবরে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, যারা এ গুরুত্বপূর্ণ চাবি রাখার দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা, তারা এত টুকু কষ্ট করতে চান না, আরাম আয়েস খুব পছন্দ করেন। সারা দিন ব্যাংকের সম্মানিত গ্রাহকদের উন্নত (?) সার্ভিস দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে দিনান্তে পিয়নকে দিয়ে ভল্ট বন্ধ করার কাজটা সেরে নেন। দীর্ঘদিন থেকে এ অনুশীলন চলে আসছে। একজন স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারীর নগদ টাকা দেখে দেখে নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের সীমাহীন লোভ একদিনে মাথা চাড়া দেয়নি। অনেকে বলেছে চোর ও তার দল যথেষ্ট বুদ্ধিমান নয়। ঠিকই তো! তা না হলে চুরি করা এত টাকা নিজ বাড়ির আঙিনায় কেউ গর্ত করে লুকায় ?

চোর ধরা পড়ল। দ্রুতই টাকা উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধন্যবাদ পুলিশ বাহিনীর সে সকল সদস্যদের।

রূপালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে কীভাবে পিয়ন, মালী, খন্ডকালীন বাবুর্চি গোছের কর্মচারীদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ চাবি যায়। সরকারি ব্যাংকের শাখা পর্যায়ের অব্যবস্থাপনা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে এ চুরির ঘটনা থেকে তার ধারণা পেতে অসুবিধা হয় না। ব্যাংকে চোর ডাকাতের তৎপরতা সম্পর্কিত অতীতের ঘটনা থেকে রূপালী ব্যাংক কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেনি।

ব্যাংকে ‘রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ বলে একটা বিষয় আছে যা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক নির্দেশনা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনবরত নির্দেশনা/সতর্কতা জারী করা হয়ে থাকে যাতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনয় সুস্থ ধারা বজায় থাকে। রূপালী ব্যাংক যদি এ সকল নির্দেশনার ছিটে ফোঁটাও পরিপালন করে চলত তা হলে অবশ্যই এ জাতীয় চুরির ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হত না।

ব্যাংকে ৩ (তিন) বছরের অধিক সময় কোন কর্মকর্তা/কর্মচারীর একই কর্মস্থলে নিয়োজিত থাকার কথা নয়। এমনও হতে পারে যে আলোচ্য ‘ভাগ্যাহত’ চোর ১০ (দশ) বছরের বেশি ওই একই কর্মস্থলে থেকে গভীর শিকড় গেড়েছিল। বুঝা যায় আবুল কালাম আজাদ না থাকলে শাখাটি অচল হয়ে পড়বে এমন কথা বার্তা অনেকের মুখে মুখে।

দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে অবস্থান করা পিয়ন, চৌকিদারের সাথে ‘বন্ধুত্ব’ সৃষ্টি করে প্রতারক চক্র ব্যাংকে অনুপ্রবেশ করে বড় বড় জালিয়াতি ঘটানোর উদাহরণ কম নয়।

নিকট অতীতে হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি, আত্মসাতের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বের করে নিয়ে গেছে সমাজের একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনা সীমাহীন। ক্ষেত্র বিশেষে বলা যায়, দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত। তার ওপর আবার যদি বেড়ায় ফসল খায় তা হলে কে রক্ষা করবে সরকারের ব্যাংক খাত ?

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।