বিশ্বজিৎ মনি : “চির নতুনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ”। বাঙ্গালীদের জীবনে একটি স্মরণীয় দিন বৃহস্পতিবার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম দিন উপলক্ষ্যে প্রতি বছরই কবিগুরুর নিজস্ব জমিদার তাঁর স্মৃতি বিজড়িত নওগাঁর পতিসর কাছারিবাড়ি প্রাঙ্গণে নামে রবীন্দ্র ভক্তের ঢল। পরিণত হয় মানুষের মিলন মেলায়।

এ মিলন মেলা চলে সপ্তাহ জুড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে কবি ভক্তরা ছুটে আসেন তাদের প্রিয় কবির পতিসর কাছারি বাড়ি প্রাঙ্গণে। একে অপরের সান্নিধ্যে এসে স্মৃতি চারণে লিপ্ত হন কবিভক্তরা। কবি গুরুর ১৫৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে এবার ব্যাপক প্রস্তুতি হাতে নেওয়া হয়েছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধণ্য কবির নিজস্ব জমিদারি নওগাঁর পতিসর যেন পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কবিগুরুর ১৫৩তম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে পতিসরকে সাজানো হয়েছে অপরূপ সাজে। কাছারি বাড়িতেই কবিগুরুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। পতিসরে নাগর নদের পাড়কে মনমুগ্ধকর করে তোলা হয়েছে। দীর্ঘদিনেও পতিসরের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন না হলেও এবার যেন হাঁটি হাঁটি পা-পা করে উন্নয়নের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে।

কবিগুরুর নিজস্ব জমিদারি এলাকা কালিগ্রাম পরগনার সদর দপ্তর এই পতিসর। আর এই পতিসর নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ মাধুর্যঘেরা কবির স্মৃতি বিজড়িত পতিসর আজও সাহিত্যের অঙ্গনে স্বাড়ম্বরে বিরাজিত। কবির যখন ভরা যৌবন এবং কাব্য সৃষ্টির প্রকৃষ্ট সময়, তখনো তিনি বিরাজ করেছেন পতিসরে। প্রতিবছর কবির এই জন্মদিনে দূর দূরান্ত থেকে কবি ভক্তরা ছুটে আসেন। তাদের প্রিয় কবির স্মৃতি বিজড়িত পতিসর কাছারিবাড়ি প্রাঙ্গণে যেন কবিভক্তদের মিলন মেলায় পরিণত হয়।

নওগাঁ থেকে ৩৫ কিলোমিটার আকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক চলে গেছে নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লীতে, কবিগুরুর কাচারিবাড়ি জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারি ইউনিয়নের পতিসর গ্রামে। আকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক হোক আর নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লী হোক তাতে কি আসে যায় ! তিনি যে আমাদের প্রাণের কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রতি বছরই এখানে বসে মানুষের মিলন মেলা। সেখানে সপ্তাহ জুড়ে চলে রবীন্দ্র মেলা। এ সময় স্থানীয় ও এলাকাবাসীদের বাড়িতে ভিড় জমায় দূর দূরান্ত থেকে আসা কবি ভক্ত, আত্মীয়-স্বজন,অতিথিবৃন্দ। একে অপরের সান্নিধ্যে এসে স্মৃতি চারণে লিপ্ত হয় ফেলে আসা বিগত দিনের কথায়। গ্রামের মানুষ মেয়ে-জামাইকে নাইওরে আনে এই উৎসবে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত পতিসরে এবার কবির ১৫৩ তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ইতোমধ্যে নওগাঁ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত প্রস্তুতি সভায় ১ দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। পতিসরে ১ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান মালার মধ্যে রয়েছে, আলোচনা সভা, স্মৃতি চারণ, নাটক, আবৃত্তি, নাচ গানসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন নওগাঁ, আত্রাই, রাণীনগর, জয়পুরহাট ,দিনাজপুর, বগুড়া, নাটোর, রাজশাহীর প্রথিতযশা শিল্পীরা। দেশি ও বিদেশি পর্যটক ও রবীন্দ্র গবেষকদের নিরাপদে রাত্রি যাপন ও গবেষণার স্বার্থে পতিসরে ৫ কক্ষ বিশিষ্ট অত্যাধুনিক “বঙ্গবন্ধু স্মৃতি নীড়” নামে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৩৭ সালে ২৭ জুলাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাজার হাজার প্রজাকে কাঁদিয়ে পতিসর বাংলাদেশ থেকে শেষ বিদায় নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি প্রজাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “সংসার থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে তোমাদেরকে দেখার ইচ্ছা ছিল তা আজ পূর্ণ হল। তোমরা এগিয়ে চল-জনসাধারণের জন্যে সবার আগে চাই শিক্ষা, সবাইকে শিক্ষা দিয়ে বাঁচাও। ইচ্ছা ছিল মান সম্মান-সম্ভ্রম সব ছেড়ে দিয়ে তোমাদের সঙ্গে তোমাদের মতই সহজ হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেব। কী করে বাঁচতে হবে তোমাদের সঙ্গে মিলে সেই সাধনা করব, কিন্তু আমার আর এ বয়সে তা হবার নয়, এই নিয়ে দুঃখ করে কী করব? আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে, তোমরা নিজ পায়ে দাঁড়াতে শেখ। আমি তোমাদেরকে বড় ভালবাসি, তোমাদের দেখলে আমার আনন্দ হয়, তোমাদের কাছে আমি অনেক কিছু পেয়েছি, কিন্তু কিছুই দিতে পারিনি-আশির্বাদ করি তোমরা সুখি হও।

তোমাদের সবার উন্নতি হোক-এ কামনা নিয়ে পরলোকে চলে যাব। আবার একই দিনে কালিগ্রাম রথীন্দ্র নাথ ইন্সটিটিউটের শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “রবীন্দ্র নাথের নাম চিহ্নিত কালিগ্রামের এই বিদ্যালয়ের আমি উন্নতি কামনা করি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকদের সম্মন্ধ যেন অকৃত্রিম স্নেহের এবং ধৈর্যের দ্বারা সত্য ও মধুর হয় এই আমাদের উপদেশ।

শিক্ষাদান উপলক্ষে ছাত্রদিগকে শাসন পীড়নে অপমানিত করা অক্ষম ও কাপুরুষের কর্ম- একথা সর্বদা মনে রাখা উচিত। এরূপ শিক্ষাদান প্রণালী শিক্ষকদের পক্ষে আত্মসম্মান হানিজনক। সাধারণত আমাদের দেশে অল্প বয়স্ক বালকগণ প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষকদের নির্মম শাসনের উপলক্ষ হইয়া থাকে- একথা আমার জানা আছে। সেই কারনেই সর্তক করিয়া দিলাম।”

শেষ বিদায়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কবির ৭৬ বছর বয়সের একটি উন্মুক্ত ভাষ্কর্য স্থাপন করা হয়েছে পতিসরে। ভাষ্কার্যটি জার্মানের কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসায় পদার্থবিদ রবীন্দ্র গবেষক প্রফেসর ড. গোলাম জাকারিয়ার আর্থিক সহযোগিতায় নির্মাণ করা হয়েছে।

(বিএম/এটি/মে ০৭, ২০১৪)