প্রবীর সিকদার : ৮ মে, ১৯৭১। আমার বাবা স্কুল শিক্ষক পরেশ চন্দ্র সিকদার, দাদু মনোরঞ্জন পোদ্দারকে ধরে নিয়ে গেল রাজাকাররা। আর আমি বাবা-দাদুকে পাইনি। কোথায় কোন অবস্থায় তাদের খুন করা হয়েছে তা আর জানা যায়নি। কোনও হদিস মেলেনি তাদের লাশেরও। ওই দিনই আমার চোখের সামনে রামদা দিয়ে কুপিয়ে, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে আর উপর্যুপুরি ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে খুন করা হয় আমার কাকা দীনেশ চন্দ্র সিকদার, জীবেশ চন্দ্র সিকদার, দুলাল চন্দ্র সিকদার, বিভূতি সিকদার, মামা আনন্দ পোদ্দার, পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ অভিভাবক অজিত সিকদার সহ আমার আরও ১১ স্বজনকে। নৃশংস এই ঘটনাটি ফরিদপুর জেলার কানাইপুর সিকদার বাড়ির। ওই দিন কানাইপুরে ধীরেন্দ্র নাথ সাহা, অজিত পোদ্দার, অশোক সিকদার, নিতাই চন্দ্র পোদ্দার, নিমাই চন্দ্র পোদ্দার, খগেন্দ্র নাথ পোদ্দার, নৃপেন্দ্র নাথ পোদ্দার, আনন্দ দত্ত, মন্মথ সেনসহ আরও অন্তত ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই কালো দিনটি ‘কানাইপুর গণহত্যা দিবস’ নামে পরিচিত হলেও কেউ দিবসটি পালন করেন না। কিন্তু ওই নৃশংস গণহত্যার নায়ক রাজাকার ফজলু মুন্সীর নামে এলাকায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় বিনা বাধায়, বেশ দাপটের সাথেই।

কানাইপুর গণহত্যার মূল নায়ক ফজলু মুন্সী ও তার ছেলে লাল মিয়া। ফরিদপুরের রাজাকার শিরোমনি আলাউদ্দিন খাঁর সহযোগিতায় সশস্ত্র বিহারী এনে সেই দিন এই নৃশংস গণহত্যার ঘটনা ঘটায় ফজলু মুন্সী ও লাল মিয়া। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ওরা ও ওদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল রাষ্ট্র। তখন ওরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। জেনারেল জিয়া সেই মামলাকে গলাটিপে হত্যা করার পর ফজলু মুন্সী ‘পীর ফজলুল হক’ পরিচয়ে দাপটের সাথে এলাকায় ফেরে। সঙ্গে তার ছেলে লাল মিয়াও। বেশ দাপটের সাথে ‘মিনি পাকিস্তান’ এর স্বাদ নিতে নিতেই মারা যায় ফজলু মুন্সী । এখনও বহাল তার ছেলে লাল মিয়া।

এই বাংলাদেশের জন্য আমি আমার বাবাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারিনি। বাংলাদেশটির জন্য আমার এই উদ্বাস্তু জীবন। রাজাকারের ইতিবৃত্ত লেখার অপরাধে বোমা হামলায় উড়ে গেছে আমার পা। তারপরও কি আমি একাত্তরের দুর্ধর্ষ খুনি রাজাকার লাল মিয়ার ফাঁসি দাবি করতে পারবো না ?

বিচার পাই আর না পাই, আমি উচ্চস্বরে দাবি করছি, লাল মিয়ার ফাঁসি চাই।

(ওএস/অ/মে ০৮, ২০১৪)